ফ্রিজের বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দাপট, বড় বাজার এখন গ্রামে

বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের রেফ্রিজারেটর বেশি চলেছবি: প্রথম আলো

দুই দশক আগেও ফ্রিজ বলতে কেবল সচ্ছল পরিবারের পণ্য বোঝাত। বেশি দাম, বিদেশ থেকে আমদানি, বাড়তি বিদ্যুৎ বিল কিংবা লোডশোডিং—এসব কারণে ফ্রিজের ব্যবহার ছিল সীমিত। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন শহর বা গ্রামের সাধারণ আয়ের পরিবারেও ফ্রিজ থাকে। আর এই পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে দেশীয় ইলেকট্রনিকস কোম্পানিগুলো।

একসময় সব ধরনের ফ্রিজই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। পরে দেশীয় একাধিক কোম্পানি ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে। এতে সরকারও শুল্কছাড়সহ নানা ধরনের নীতি–সহায়তা দিয়েছে। ফলে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ফ্রিজ। দেশীয় কোম্পানির সফলতা দেখে অধিকাংশ বিদেশি কোম্পানিও এ দেশে তাদের ফ্রিজ সংযোজন বা উৎপাদন শুরু করেছে।

কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, দেশে মানুষের আয় বাড়ছে; তাঁদের জীবনমানও প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে ফ্রিজের ব্যবসাতেও। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবছর ২৫–৩০ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। সাধারণত এ বাজার বছরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও ফ্রিজ রপ্তানি হচ্ছে।

করোনার পর থেকে ফ্রিজের ব্যবসা কিছুটা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কখনো ব্যবসা বাড়ছে; কখনো ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তাঁরা বলছেন, দেশে ফ্রিজের বড় বাজারের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ডলার–সংকট, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, সুদহার বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে ব্যবসায় আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি আসছে না।

দেশীয় কোম্পানির দাপট

দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনের প্রথম উদ্যোগ নেয় দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তারপর একে একে যমুনা, মিনিস্টার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ট্রান্সকম ও ওরিয়ন দেশে কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে ফ্রিজের বাজারে ১০টির বেশি দেশীয় ব্র্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে ওয়ালটন, মার্সেল, মিনিস্টার, মাই ওয়ান, যমুনা, ট্রান্সটেক, ভিশন, ইলেকট্রা, র‍্যাংগ্‌স, ওরিয়ন, হাইকো, স্মার্ট, ইকো প্লাস প্রভৃতি।

ইনফোগ্রাফ: নিরুপম চক্রবর্তী

অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত বিদেশি ব্র্যান্ডের ফ্রিজের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গার, স্যামসাং, কনকা, এলজি, ওয়ার্লপুল, হায়ার, হিটাচি, হাইসেন্স প্রভৃতি। আর শার্প, প্যানাসনিক, সিমেন্স ইত্যাদি বিদেশি ব্র্যান্ডের ফ্রিজও দেশের বাজারে বিক্রি হয়। যেসব কোম্পানি এখন সংযোজন করছে, তারাও ভবিষ্যতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।

ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি হয়, তার মধ্যে দেশীয় কোম্পানির হিস্যা ৮০–৯০ শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ফ্রিজ দিয়েই অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশ মিটছে।

ওয়ালটন রেফ্রিজারেটরের প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা (সিবিও) তাহসিনুল হক বলেন, ফ্রিজ এখন পরিবারের মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে। ফলে শহর–গ্রামনির্বিশেষে মানুষ ফ্রিজ কিনছেন। দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন ফ্রিজ রপ্তানি করছে। যেমন ওয়ালটন একাই অর্ধশত দেশে ফ্রিজ রপ্তানি করছে।

বড় বাজার এখন গ্রামে

দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যান নেই। তবে জার্মানিভিত্তিক বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ফ্রিজের বাজার ছিল ১৫৩ কোটি ডলারের বা প্রায় ১৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার। বর্তমানে সেই বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৩ কোটি ডলারে। স্ট্যাটিস্টা বলছে, ২০২৯ সাল নাগাদ ফ্রিজের দেশীয় বাজার ২৯৬ কোটি ডলারে (বর্তমান মূল্যে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা) পৌঁছাতে পারে।

স্ট্যাটিস্টার হিসাবে, বাসাবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পে ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ফ্রিজ ও কুলার-জাতীয় যন্ত্রকেও ধরা হয়েছে। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বর্তমানে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ফ্রিজের বাজার ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর দেশে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ফ্রিজের বাজার বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে (২০২৩) বলা হয়েছে, দেশে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি ফ্রিজ রয়েছে; অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি পরিবারে ফ্রিজ ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৪৫-এর কিছু বেশি।

বিক্রেতারা জানান, দেশে বছরে যত রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ বিক্রি হয়, তার বড় অংশ হয় গ্রামে। স্থানীয় চাহিদা বাড়ায় উপজেলা ও বড় ইউনিয়ন পর্যায়ে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান গড়ে উঠেছে। গ্রামে ফ্রিজ বিক্রি বাড়ার আরেকটি কারণ সাশ্রয়ী মূল্য। সাধারণত ১৫ হাজার থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দামের মধ্যে ফ্রিজ পাওয়া যায়। তবে গ্রাম এলাকায় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার আশপাশের দামেই বেশি ফ্রিজ বিক্রি হয়।

দেশীয় কোম্পানি ইলেকট্রো মার্ট কনকা ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নুরুল আফছার বলেন, গ্রামে ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। সড়ক ও অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের ফ্রিজ কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আগের তুলনায় কৃষি থেকে আয় ও কর্মসংস্থান বেড়েছে; অনেক পরিবার প্রবাসী আয় পায়। ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ফ্রিজ বিক্রিতে।

বেশি বিক্রি দুই ঈদে

গ্রাহকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বর্তমানে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন আকার, প্রযুক্তি ও বাহারি নকশার ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটর বাজারে আনছে। যেমন আধুনিক ফ্রিজগুলোকে ফাস্ট কুলিং, টেম্পারড গ্লাস, বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, ভালো কম্প্রেসর প্রভৃতি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার ছোট পরিবার, ব্যাচেলর, ফার্মেসি, হাসপাতাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও দোকানে ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন আকারের ফ্রিজ উৎপাদন করছে কোম্পানিগুলো।

দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীরা জানান, সারা বছরই ফ্রিজের চাহিদা থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দুই ঈদে, যা মোট বিক্রির ৬০–৭০ শতাংশ। কারণ, এ সময় সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে ফ্রিজের চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে কোরবানি ঈদের সময় ফ্রিজারের (ডিপ ফ্রিজ) চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। আসছে রোজার ঈদ সামনে রেখেও ফ্রিজের বিক্রি বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ওয়ালটনের বিক্রয়কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাধারণ সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রি ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ ভিশন ব্র্যান্ডের ফ্রিজ বাজারে বিক্রি করে। প্রাণ–আরএফএল গ্রুপে পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, সার্বিকভাবে দেশে ফ্রিজের বাজার আগের তুলনায় ভালো। এ কারণে সব কোম্পান সরবরাহব্যবস্থা ঢেলে সাজাচ্ছে। তবে ইলেকট্রনিকস খাত বিকাশের এখনো অনেক সুযোগ রয়েছে। ফলে সরকার এ খাতে কর–ভ্যাট অবকাশসহ যেসব নীতিসুবিধা দিয়েছে, সেগুলো অব্যাহত রাখা জরুরি।