সকাল আটটা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া। সতর্ক অবস্থানে পুলিশ, এপিবিএন ও আনসারের বিপুলসংখ্যক সদস্য। এরপর বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তাঁরা কয়েক দফা শনির আখড়া বাজার হয়ে কাজলার মোড় প্রদক্ষিণ করেন। পরে অবস্থান নেন শনির আখড়ার দনিয়া কলেজের সামনে। আগে থেকে সেখানে অবস্থান নিয়ে আছেন যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে শনির আখড়ার অদূরে মাতুয়াইল শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে বিএনপির কয়েক শ নেতা-কর্মী। তাঁদের হাতে লাঠি, মুখে সরকারবিরোধী স্লোগান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দাঁড়িয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা।
বেলা সাড়ে ১১টার পর শনির আখড়া থেকে সাঁজোয়া যান, জলকামান নিয়ে পুলিশ সদস্যরা এগোতে থাকেন মাতুয়াইল শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দিকে। পুলিশের পেছনে পেছনে লাঠি হাতে ছিলেন যুবলীগের নেতা-কর্মীরাও। একপর্যায়ে দূর থেকে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকেন। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকেন ইটপাটকেল। আতঙ্কে লোকজন ছুটতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শনিবার এমন ‘ভীতিকর’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশে বাসসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আটকে যায়। বাস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে দেখা যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের।
পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট আর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মারমুখী অবস্থানের কারণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেককে বাস থেকে নেমে দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে দেখা যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পুলিশ এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
বেলা একটার দিকে যখন শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশে স্বদেশি পরিবহনের একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়। তখন মাতুয়াইলের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশের দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে যান ব্যবসায়ীরা।
মাতুয়াইলের বাসিন্দা আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ভীতিকর পরিস্থিতি আমরা বহুদিন দেখিনি। সড়কে শত শত পুলিশ অবস্থান নিয়েছে; বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাতে লাঠি। যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হাতেও লাঠি। এমন দৃশ্য দেখে আমরা ভয় পাচ্ছি।’
পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার পর সংঘর্ষ কিছুটা কমে এলে যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা যানবাহন দ্রুত কাঁচপুরের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার বিএনপির নেতা-কর্মীরা শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। পুলিশ তখন পিছু হটে রায়েরবাগের দিকে চলে যায়। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে ধাওয়া দেন, ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন আবার দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে টায়ারে আগুন ধরিয়ে সড়কে অবস্থান নেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরে শনির আখড়া থেকে আরও পুলিশ এসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিলে তাঁরা আবার শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গলিতে অবস্থান নেন। তখন পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকেন।
হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে
মাতুয়াইলে সংঘর্ষের খবরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢাকাগামী সব যানবাহনের যাত্রীদের কাঁচপুর, সাইনবোর্ডে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা কাঁচপুর থেকে হেঁটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মাতুয়াইলে শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে পড়ে থাকা ইটের টুকরা, জ্বলন্ত টায়ার ও জ্বলন্ত বাস দেখে এসব মানুষের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ।
কুমিল্লা থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ওমর ফারুক। মাতুয়াইলে সংঘর্ষের খবরে তাঁদের কাঁচপুরে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। হেঁটে ওমর ফারুকরা যখন মাতুয়াইল পার হচ্ছিলেন, তখন কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাস থেকে নামাইয়া দিছে। হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। দুই গাড়ির মধ্যে আগুন লাগাইয়া দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে যাচ্ছি।’
হঠাৎ আগুন, আবার আতঙ্ক
বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দূরে সরে গেছেন, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠি হাতে সড়কে। সড়কে সতর্ক অবস্থানে পুলিশ ও র্যাব। পরিস্থিতি তখন অনেকটাই শান্ত। ঠিক তখন মাতুয়াইলের শান্ত ফিলিং স্টেশনের সামনে তিন যুবক একটি বাসে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকের এই ঘটনায় মাতুয়াইলের বাসিন্দাদের মধ্যে আবার আতঙ্ক ছড়ায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে তিনজন যুবক সবার সামনে বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা খুব ভয়ে আছি, কখন যে কী হয়!’