এয়ারবাসের পর বোয়িংয়ের প্রস্তাব

  • এখন বহরে আছে ২১টি উড়োজাহাজ, এর মধ্যে বোয়িংয়ের ১৬টি, ৫টি ড্যাশ–৮।

  • যাত্রী পরিবহনে সক্ষমতার ৭৬% এবং কার্গোর ৬–১০% কাজে লাগাতে পারছে।

বিমান
প্রতীকী ছবি

ইউরোপীয় কোম্পানি এয়ারবাসের পর যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানিও উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে। ফ্লাইট ও বহর সম্প্রসারণ নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রধান দুই উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানির প্রস্তাব নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিমান সূত্র জানায়, আজ সোমবার বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সভায় বোয়িংয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সভার আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বোয়িং কোম্পানি তাদের ড্রিমলাইনার বোয়িং–৭৮৭–৯ এবং ৭৮৭-১০ উড়োজাহাজ বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে।

আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। বোয়িংয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর আকাশপথে যাত্রী বাড়বে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। ১০ বছর পরে যাত্রীর সংখ্যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ।

এর আগে এয়ারবাস ১০টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দেয়। সেটার বিষয়ে ৩ মে অনুষ্ঠিত সভায় প্রাথমিক সম্মতি দেয় বিমানের পরিচালনা পর্ষদ। এরপর ৬ মে লন্ডনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এ–সংক্রান্ত যৌথ ঘোষণা সই হয়। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে লিখিতভাবে জানানো হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এয়ারবাস থেকে আটটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ কিনবে বিমান। পরবর্তী সময়ে আলোচনা সাপেক্ষে আরও দুটি মালবাহী (কার্গো) উড়োজাহাজ কেনা হবে।

আরও পড়ুন

বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার সম্মতি দেওয়া হলেও এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বহর পরিকল্পনা এবং কারিগরি ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করার পর সিদ্ধান্ত নেবে বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে।

বর্তমানে বিমানের বহরে বেশির ভাগ উড়োজাহাজ বোয়িং কোম্পানির। নতুন করে অন্য কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনা সাশ্রয়ী মনে হলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় বিবেচনায় নিলে তা বিমানের জন্য লাভজনক হবে না।
বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল

বোয়িংনির্ভর বিমানের বহর

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এখন মোট উড়োজাহাজ ২১টি। এর মধ্যে ১৬টি বোয়িংয়ের এবং ৫টি কানাডার ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ। অতীতে কখনো এতসংখ্যক এবং নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বিমানের বহরে ছিল না।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সাল থেকে উড়োজাহাজগুলো আসা শুরু হয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১৪টি উড়োজাহাজ কেনা হয় বোয়িং থেকে। এ ছাড়া ২০১৯ সালে আরও দুটি ভাড়ায় আনা হয়েছে। এর বাইরে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য চারটি ড্যাশ-৮ কেনা হয় এবং একটি ভাড়ায় আনা হয়।

বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন এস এম হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিমানের বহরে বেশির ভাগ উড়োজাহাজ বোয়িং কোম্পানির। নতুন করে অন্য কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনা সাশ্রয়ী মনে হলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় বিবেচনায় নিলে তা বিমানের জন্য লাভজনক হবে না। তবে এয়ারবাসের প্রস্তাবের কারণে বোয়িংয়ের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগ বাড়বে।

আরও পড়ুন

যাত্রী পরিবহনে সক্ষমতা

বর্তমানে ৭টি অভ্যন্তরীণ ও ১৬টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে (একটি আপাতত বন্ধ) ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। গত ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৪১৫ জন এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ২৭ লাখ ১১ হাজার ৩৬৭ জন যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে বিমানের। ২০২২ সালে এই সক্ষমতার প্রায় ৭৬ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে।

আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। বোয়িংয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর আকাশপথে যাত্রী বাড়বে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে। ১০ বছর পরে যাত্রীর সংখ্যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ।

বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদের সভায় উঠছে আজ। এর আগে এয়ারবাসের প্রস্তাবে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে পর্ষদ।

বেসরকারি বিমান সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এই খাতের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, কোনো বিমান সংস্থার যাত্রী পরিবহন ৭৫-৮০ শতাংশে উঠলে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করতে হয়। তবে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে হবে। লোকসান দিয়ে সক্ষমতার শতভাগ যাত্রী পরিবহন করার পর বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করলেও লোকসানই হবে।

কার্গো পরিবহনে সক্ষমতা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কেবল মালবাহী (কার্গো) উড়োজাহাজ নেই। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজেই মালামাল পরিবহন করা হয়। এ ক্ষেত্রে সক্ষমতার বেশির ভাগই বিমান কাজে লাগাতে পারে না।

বেবিচকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে বিমানের মালামাল পরিবহনের সক্ষমতা ছিল ৩৯ হাজার ৬৯৬ টন। কিন্তু বিমান পরিবহন করেছে ৩ হাজার ৮২০ টনের মতো; যা সক্ষমতার মাত্র ১০ শতাংশ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা ছিল প্রায় ৫ লাখ টন। বিমান পরিবহন করেছে ২৮ হাজার ৮৭ টন; যা সক্ষমতার মাত্র ৬ শতাংশ।

এমন বাস্তবতায় এয়ারবাসের কাছ থেকে কার্গো উড়োজাহাজ কেনার যে চিন্তাভাবনা চলছে, সেটার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন অবস্থায় নতুন কার্গো উড়োজাহাজ কেনাটা লাভজনক হবে না।

বহরে বৈচিত্র্য কতটা জরুরি

বড় বিমান সংস্থাগুলোর বহরে বোয়িং ও এয়ারবাস—দুই প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজই বেশি থাকে। এই যুক্তিতে বিমান বাংলাদেশের বহরেও বৈচিত্র্য আনতে চান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু বিমানের বহর খুবই ছোট। বর্তমান বহরে বেশির ভাগ উড়োজাহাজ বোয়িংয়ের হওয়ায় ইতিমধ্যেই এ ধরনের উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ ও চালানোয় বিমানের কর্মীরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এমন ছোট বহরে একাধিক কোম্পানির উড়োজাহাজ যুক্ত হলে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি বৈমানিক ও কেবিন ক্রুদের নতুন করে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত কর্মীদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হবে।

তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর মতে, বহরে বৈচিত্র্য থাকলে সমস্যা হবে না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাসের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ, কয়টি উড়োজাহাজ তাদের কাছে কেনা হবে, সে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।