তারা সব দল বেঁধে চলে গেছে

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কী বিদেশে; নাম–ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের উত্তর–পূর্বের পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়িতে। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত হারিকেন জ্বালিয়ে পড়েছি। আমাদের সবারই ভাষাগত সমস্যা ছিল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার সমস্যা। আমাদের ছিল কো-এডুকেশন বা সহশিক্ষা। মেয়েরা ক্লাসরুমের এক পাশে আর আমরা ছেলেরা আরেক পাশে বসতাম।

অনেকের নাম ও চেহারা এখন আর মনে নেই। দশম শ্রেণি পর্যন্ত কারা কারা ছিল? দেবতোষ, জলদেশ্বর, ইন্দুপ্রিয়, প্রফুল্ল, প্রদীপ, শুভরঞ্জন, মনোরঞ্জন, রামেন্দু, সুহাস জীবন, অজয়, সামাদ, পাইলা প্রু চৌধুরী, মংয়্যু, ছত্র নারায়ণ, উচিৎময়, পূর্ণিমা, অমরাবতী, শাহেদা, সুষমা, তাপসী, রাখী, স্মৃতিরানী, মেরিনা—এদের নাম মনে করতে পারছি। সংখ্যায় বাঙালি ছাত্রছাত্রী খুব কম ছিল। তার মধ্যে সামাদের পরিবার মূলত ব্যবসায়ী। বাড়িঘর সব চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। প্রায় সময় সে স্কুল কামাই করত। বসত একদম পেছনের সারিতে। কিন্তু কেন জানি তারপরও তার সঙ্গে আমার একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মনে হয় সামাদ বাঙালি মুসলিম বলে আমার একটু অন্য রকম আগ্রহ ছিল। নবম কিংবা দশম শ্রেণিতে এসে দুজন বাঙালি মুসলিম ছাত্রী যোগ দিল—একজন শাহেদা, আরেকজনের নাম এখন মনে পড়ছে না।

আমি যখন বুয়েটে প্রথম বর্ষে, তখন খাগড়াছড়িতে থমথমে অবস্থা। শান্তি বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সংঘাত চলছে। খাগড়াছড়িতে তখন একধরনের অঘোষিত কারফিউ।

এক ঈদের বন্ধে বাড়ি গিয়ে শাহেদার সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা। আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। ওর বাবা আবার বদলি হয়ে এসেছে। এখানে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। এখন বেশ সপ্রতিভ, তেমন জড়তা নেই। ঈদের দাওয়াত দিল। অবাক হলাম যখন ওর আম্মাও ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে খুব আপন হয়ে গেলেন। শাহেদার চোখে–মুখে খুশির ঝিলিক। বিদায় নেওয়ার সময় বাইরে বেরিয়ে দেখি, কনে দেখা আলোয় আকাশটা ভরে আছে, চারপাশটা এত সুন্দর লাগছে।

এর এক বছর পর গিয়ে শুনলাম, ওরা বদলি হয়ে গেছে। সম্ভবত সহপাঠিনীদের মধ্যে শাহেদার সঙ্গেই আমার শেষ দেখা হয়েছিল।

মং রাজার মৃত্যুর পর আদালতের রায়ে সহপাঠী ও বন্ধু পাইলা প্রু চৌধুরী মং রাজা হলো। এর বছর সাতেক পরে, তখন আমি কুমিল্লায়। ঢাকা থেকে নাইট কোচে খাগড়াছড়ি ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পাইলা প্রুর মৃত্যু হয়। মুঠোফোনে সংবাদটি শুনে আমি অনেকক্ষণ হতবাক হয়ে বসে ছিলাম।

অমরাবতীর দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। একদিন জানলাম সে নেই। সুহাস জীবন ছিল বান্দরবানের অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। ২০১১ সালে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামে মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে নৃশংসভাবে খুন হয়। এই অপমৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। প্রফুল্লও সময় দিল না, ক্যানসার ধরা পড়ার মাস তিনেকের মাথায় চলে গেল অন্য ভুবনে।

বছর দুয়েক আগে বাড়ি গেলাম। ভাবলাম অনেক দিন দেখা হয়নি, সামাদের খবর নিই। তার দোকানে খবর নিতে গেলাম। তার ভাই জানাল, ভাই তো নেই, চলে গেছে মাস ছয়েক হলো। আমি বজ্রাহতের মতো বসে রইলাম অনেকক্ষণ, বলার মতো কোনো কথা মুখে আসছিল না। বছর তিনেক আগে বাড়ি গিয়ে শুনলাম, দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগে ইন্দুপ্রিয় চলে গেছে।

আমি আমার সহপাঠী–সহপাঠিনীদের নাম দিয়ে অন্তর্জালে অনেক খুঁজি। কিন্তু না, কেউ নেই। হঠাৎ যেন সবাই দল বেঁধে কোথায় চলে গেছে আমায় কিছু না বলে।