‘আগে কোর্টে আসলে ভয় পেতাম, আজকে ভয় লাগেনি’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায় শুনানি শেষে ১২ বছরের এক শিশু আদালতের বারান্দায় যখন আসে, তখন তার চোখে সেই বিমর্ষ ভাবটা আর নেই। নির্ভার তার স্বজনেরাও। আজ সোমবার চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের বিচারক ফেরদৌস আরার আদালতের সামনে এই চিত্র দেখা গেছে। শিশুটি প্রথম আলোকে বলে, ‘আগে কোর্টে (আদালতে) আসলে ভয় পেতাম। আজকে ভয় লাগেনি।’
শুধু ১২ বছরের ওই শিশু নয়, বিচারাধীন মামলায় এদিন আদালতে হাজির হওয়া শিশু–কিশোরদের সবাইকে দেখা গেছে ভিন্ন চেহারায়। আজ লালসালু ঘেরা প্রচলিত এজলাসে বিচার কার্যক্রম হয়নি। এদিন শিশু আইন অনুযায়ী শিশুদের জন্য আলাদা এজলাস তৈরি করা হয় ওই আদালতে। সেখানে ছিল না আসামি ও সাক্ষীর কাঠগড়া। বিচারক বসেননি তার জন্য নির্ধারিত প্রচলিত এজলাসের চেয়ারে। সরকারি কৌঁসুলি ও আইনজীবীদের কারও গায়ে ছিল না কোট, গাউন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের পরনে ছিল না ইউনিফর্ম। এজলাসের ভেতর বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলি ছোট ছোট টেবিলে বসেন। সামনে আইনজীবীরা তাদের নির্ধারিত আসনে। এজলাসের ভেতরে ছিলেন না কোনো পুলিশ সদস্য। শিশুবান্ধব পরিবেশে শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি এম এ নাসের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম শিশু আইন অনুযায়ী আলাদাভাবে শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দাগি অপরাধীদের সঙ্গে শিশুদের বিচারকাজ হচ্ছে না। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আগামী দিনের কান্ডারি এসব শিশু ইতিবাচক চিন্তা করতে পারবে।
নাসের চৌধুরী আরও বলেন, শুনানিকালে বিচারক মামলার আসামি প্রতিটি শিশু–কিশোরকে ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধে না জড়াতে উদ্বুদ্ধ করছেন। ভালো হয়ে চলতে কার কী সমস্যা, তা জানার চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে শিশুদের অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনে ‘চট্টগ্রামে শিশু আসামিদের বিচারে নেই পৃথক এজলাস’ এবং পরদিন ৬ আগস্ট পত্রিকায় ‘এজলাসে দাগিদের সঙ্গে শিশুরা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিশুদের জন্য আলাদা এজলাস চালুর উদ্যোগ নেয়।
চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি মোড়সংলগ্ন এলাকায় ‘পরির পাহাড়’ নামে পরিচিত এলাকায় আদালত ভবন অবস্থিত। এখানে জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালত, সাতটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ ৭৫টি আদালতে বিচারকাজ চলে। নগর ও জেলার ৩৩টি থানা এলাকার শিশুদের মামলার বিচার সাতটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হয়।
আইনজীবীরা জানান, এখানে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি আসামি মামলার শুনানির জন্য আদালতে হাজির হন। তাঁদের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতি মামলার আসামিও রয়েছেন।
১২ বছরের ওই শিশু আদালতের বারান্দায় প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি এখন জামিনে আছি। শুনানিকালে বিচারক আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করে বলেছেন, যাতে নতুন করে অপরাধে না জড়াই। আমি তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করব।’
শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবা ব্যবসার বাহক হিসেবে জড়িয়ে পড়ে তাঁর ছেলে। ওই ঘটনার পর তারা এখন সচেতন। এক মাস আগেও সদরঘাট থানার মাদক মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিল তার ছেলে। যতবারই আদালতে এসেছে, আতঙ্কের মধ্যে ছিল। এবার তাঁর ছেলে ভয় পায়নি। বরং নিজেকে এই পরিবেশ পেয়ে সংশোধনের জন্য গড়ে তুলবে বলে জানিয়েছে।
নগরের সদরঘাট থানার একটি মাদকের মামলায় আজ আদালতে সাক্ষ্য দেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন বড়ুয়া। বর্তমানে তিনি কোতোয়ালি থানায় কর্মরত। তাঁকেও সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। বিচারক ও আইনজীবীদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এই মামলার সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্য শেষে বেরিয়ে আদালতের বারান্দায় নয়ন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ২১ বছরের চাকরিজীবনে অনেক মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর মধ্যে শিশু মামলাও ছিল। কিন্তু আজ জীবনে প্রথম তিনি অন্যভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ ও শিশু আদালত চট্টগ্রামের বেঞ্চ সহকারী কফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার ২৬টি মামলার শুনানি হয়েছে। প্রতি মাসের চার দিন শুধু শিশুদের মামলার বিচার কার্যক্রম চলবে। যাতে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন খুন, ধর্ষণসহ অন্য মামলার আসামিদের সংস্পর্শে শিশুরা না আসে।
যা আছে শিশু আইনে
২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৮ সালে আইনটির কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। শিশু আদালতের অধিবেশন ও ক্ষমতা সম্পর্কে আইনের ১৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তা ছাড়া যত দূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের মতো কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালতকক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।
শিশু আদালতের পরিবেশ ও সুবিধাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে ১৯ ধারায়। ১৯(১) ধারামতে, শিশু আদালত কক্ষের ধরন, সাজসজ্জা ও আসনবিন্যাস বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে; ১৯ (২) ধারামতে আদালতের আসনবিন্যাস এমনভাবে করতে হবে, যেন সব শিশু বিচারপ্রক্রিয়ায় তার মা–বাবা বা তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যত দূর সম্ভব সন্নিকটে বসতে পারে।
শিশু আইনের ১৯(৪) ধারায় বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালতকক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফর্ম পরিধান করতে পারবেন না।
জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত প্রবেশন কর্মকর্তা মনজুর মোরশেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, আলাদা এজলাসে শিশুবান্ধব পরিবেশে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে চট্টগ্রামের একটি শিশু আদালতে। এতে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।