দেশে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে বা জোগানে সংকট দেখা দিলে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা নতুন নতুন পরামর্শ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান গমের আটার বদলে চালের আটার রুটি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন।
মন্ত্রীর এই পরামর্শ শুনে বাজারে গেলে কিছুটা হোঁচট খেতে হবে। কারণ, দেশে এখন আটা আর মোটা চালের দাম প্রায় সমান। প্রতি কেজি মোটা চাল আর প্যাকেট আটা ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি হিসাবে দেশে বছরে ৩ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপর চালের প্রয়োজন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর হিসাবে এই পরিমাণ আরও বেশি। ইউএসডিএ বলছে, চালের প্রয়োজন এর চেয়ে আট লাখ টন বেশি। ইউএসডিএর হিসাবে চালের প্রয়োজন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন। এত চাল দেশে নেই। গত বছরের মতো এবারও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হবে। সরকার এরই মধ্যে চাল আমদানি বাড়াতে শুল্ক ৬৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। সেই চালও আনতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ, ডলারের দাম ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। বিশ্ববাজারে চালের দামও বাড়ছে।
অন্যদিকে দেশে বছরে গমের চাহিদা প্রায় ৮৫ লাখ টন। এর ৭৫ লাখ টন বিদেশ থেকে আনতে হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরে ৪০ লাখ টন গম আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে আটার দাম বাড়ায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর পরামর্শ দেওয়ার আগেই মানুষ ভাত খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে প্রতিমন্ত্রী অবশ্য ভাত না, চালের রুটি খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর হয়তো জানা নেই দেশে আটার রুটির বদলে চালের রুটি খাওয়া বাড়লে সামগ্রিকভাবে চালের চাহিদা বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে সরকারি হিসাবে এ বছর পূর্বাভাসের তুলনায় সাড়ে তিন লাখ টন চাল কম উৎপাদিত হবে। তার মানে সাধারণভাবে দুই বেলা ভাতের জোগান দিতেই বিদেশ থেকে এ বছর আরও বেশি চাল আমদানি করতে হবে। আর মানুষ যদি প্রতিমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চালের রুটি খাওয়া শুরু করে তাহলে দেশে ন্যূনতম ৪০ লাখ টন চালের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে।
ধরে নেওয়া যাক, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ গম আমদানির বদলে চাল আমদানি বাড়িয়ে দিক। এই পরামর্শ মানতে গেলে বিপদ কিন্তু আরও বাড়বে। কারণ, বিশ্ববাজারে চাল ও গমের দাম এবং উৎপাদনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে।
সাধারণভাবে বিশ্বে বড় সংকট দেখা না দিলে গমের বাজারে সরবরাহ ও দাম স্থিতিশীল থাকে। কারণ, বিশ্বে মোট চারটি অঞ্চলে গমের চাষ বেশি হয়। ইউরোপে ফ্রান্স ও বুলগেরিয়া। আর কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে বলা হয় বিশ্বের গমের সবচেয়ে বড় ভান্ডার। ওই অঞ্চলের গমের দামও কম। মূলত বিশ্বের গরিব ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ওই অঞ্চলের গম আমদানি করে থাকে। এর বাইরে আছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া। এসব এলাকার গমের দাম বেশি। বাংলাদেশে মূলত বেকারি ও পাঁচ তারকা হোটেলে এই গম আনা হয়। এগুলো প্রায় ৮০ টাকা কেজি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের পক্ষে এই দামে গম কেনা সম্ভব নয়।
এখন যদি আমরা চালের আটার রুটি খাওয়া শুরু করি, তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে। কারণ, বিশ্বে চালের বাজার প্রথমত ভারত ও পাকিস্তান; দ্বিতীয়ত থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বে রপ্তানিযোগ্য চালের পরিমাণও খুবই কম। এক কোটি টনের মতো। যার বড় অংশ আবার চীন ও পূর্ব এশিয়ার অন্য বড় দেশগুলো কিনে নেয়। বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে চালের অনিয়মিত ক্রেতা। ফলে বাংলাদেশ যে বছর বিশ্ববাজারে চাল কিনতে গেছে সে বছরই দাম বেড়ে গেছে। গত এক যুগের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। আর ২০০৮ সালে ভারত থেকে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে তিন বছর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়েছে। এ বছরও চাল আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে একই পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে।
তাই প্রতিমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রণালয়ের বাইরে গিয়ে হঠাৎ চালের রুটি খাওয়ার পরামর্শ কীভাবে দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এ বিষয়ে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা থাকলে তিনি আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারতেন।