নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরই লক্ষ্য 

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এই সরকারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। নতুন সরকারের চিন্তা অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে তরুণ এই উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

প্রথম আলো:

আপনারা যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো। আপনারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হলেন। আপনাদের আগামী দিনের চিন্তা কী?

নাহিদ ইসলাম: ছাত্র–নাগরিকের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। এখন তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আমাদের আগামী দিনের চিন্তা হচ্ছে, যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আমরা এই অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছি, যে প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, আত্মত্যাগ করেছেন, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা।

আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে স্বৈরতন্ত্র আর কখনো ফিরে আসতে পারবে না, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে; যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার থাকবে। সেই বৃহৎ লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করবে। 

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকারের এই মুহূর্তের করণীয় বা অগ্রাধিকারগুলো কী?

নাহিদ ইসলাম: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে, মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, এই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা পুলিশের ভেতরে যে ধরনের পুনর্গঠন বা সংস্কার প্রয়োজন, সেটি করার পাশাপাশি আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, শিক্ষার্থীদের আবার শিক্ষামুখী করা—এই বিষয়গুলোকেও সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।

প্রথম আলো:

এই সরকারের মেয়াদ কত দিন হতে পারে? এ বিষয়ে আপনাদের চিন্তা কী?

নাহিদ ইসলাম: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান একটি লক্ষ্য হচ্ছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া তৈরি করা। এ বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ অনেক দিন ধরে ভুগছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক সুষ্ঠু কোনো প্রক্রিয়া ছিল না, মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করবে। এর জন্য কিছু সংস্কার বা পুনর্গঠন প্রয়োজন। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তার রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। সেই কাজটি করতে যে সময় লাগবে, সে অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্ধারিত হবে। তবে অবশ্যই দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই লক্ষ্য থাকবে।

প্রথম আলো:

ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলছেন অনেকে। এ বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী?

নাহিদ ইসলাম: ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী রাজনীতির যে ট্রমা শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে আছে, সেটি ভুলবার নয়। বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা রক্ত দিয়ে দেশের মানুষের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে। 

ক্যাম্পাসগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাস ও পেশিশক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই বলেই শিক্ষার্থীরা মনে করে। মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক বিকাশ এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য শিক্ষার্থীরা কাজ করবে, জাতীয় স্বার্থে শিক্ষার্থীরা কথা বলবে। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি ছাত্র সংসদভিত্তিক হওয়া উচিত। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। সেই জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের এই দাবি গুরুত্বপূর্ণ। খুব দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলেই ঠিক করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কীভাবে পরিচালিত হবে। 

প্রথম আলো:

আপনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এখন সাইবার নিরাপত্তা আইন, উপাত্ত সুরক্ষা আইনসহ বিতর্কিত আইনগুলোর বিষয়ে কী করবেন? মানুষের ফোনে আড়ি পেতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা লঙ্ঘন, এর জন্য যে সফটওয়্যারগুলো কেনা হয়েছিল, সেগুলো কোথা থেকে কেনা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হবে কি না? 

নাহিদ ইসলাম: তথ্যপ্রযুক্তি রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত আন্দোলনে ইন্টারনেট বন্ধ করে একটা ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন তৈরি করা হয়েছিল। ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার এখন আন্তর্জাতিকভাবেই মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। সেই জায়গা থেকে ওই ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রয়োজন। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে যে ধরনের সমালোচনাগুলো আছে, যেগুলো আপনি উল্লেখ করলেন, সে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে আমি সচেষ্ট থাকব।