বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা–স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা একশনএইডের করা এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪টি দেশের ওপর এই সমীক্ষা করেছে একশনএইড। তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে নারী, মেয়ে ও শিশুরা বেশি সমস্যায় পড়েছে।
ফলে তাদের শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আপস করতে হচ্ছে। এ সময়ে বাংলাদেশসহ ১০টি দেশে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে।
মূল্যবৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চাপ বাল্যবিবাহের হারও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সমীক্ষাটি করা হয়েছে গত পয়লা মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিলের মধ্যে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১৪টি দেশের মোট ১ হাজার ১০ জনের কাছে অংশগ্রহণকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তখন গমের পণ্য, রান্নার তেল, পেট্রল, রান্নার জন্য গ্যাস, সার ও স্যানিটারি প্যাডের দাম কত ছিল। এসব পণ্যের ওই দামের সঙ্গে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের (যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে) আগের দামের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময়ে বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকগুলো মাপকাঠিতে বেড়েছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে।
বাংলাদেশে সারের দাম ১০৫ শতাংশ, গম পণ্যের দাম ৭০ শতাংশ, চিনির দাম ৬০ শতাংশ, পেট্রলের দাম ৪৭ শতাংশ এবং স্যানিটারি প্যাডের দাম ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
আর ১৪ দেশ মিলিয়ে গড়ে সারের দাম ১১৮ শতাংশ, গম পণ্যের দাম ১০১ শতাংশ, চিনির দাম ৫৯ শতাংশ, পেট্রলের দাম ৮০ শতাংশ এবং স্যানিটারি প্যাডের দাম ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পণ্যগুলোর দুই সময়ের দাম উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর চার ধরনের সারের দাম দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের দাম প্রতিকেজি ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৯ টাকা থেকে ২১ টাকা, টিএসপি ২৫ টাকা থেকে ২৭ টাকা, এমওপি ১৮ টাকা থেকে ২৩ টাকা হয়েছে।
একশনএইডের গ্লোবাল পলিসি অ্যানালিস্ট আলবার্টা গুয়েরা বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি প্রান্তিক মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদ ডেকে আনছে। বিশেষত নারী ও কন্যাশিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার একজন বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের নিরাপত্তার চেয়ে শিক্ষা অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেদের বাংলাদেশে পাথর কোয়ারিতে বা যাদুকাটা নদীতে প্রতিদিন ৩০০ টাকায় বালু উত্তোলনের কাজ করতে হয়। এ কারণে তারা স্কুলে যেতে পারে না।’
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু বিপর্যয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, কোভিড-১৯, ঋণের চাপ এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে একাধিক সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। এই কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু বিপর্যয়, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘জ্বালানির দামের অস্থিরতা সব ক্ষেত্রেই সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে খাদ্যের ওপর, যা নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে। যদি আমরা বাস্তব দৃষ্টিতে দেখি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এখন চাল এবং ডিমের মতো প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জন্য আগের দামের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিতে হচ্ছে। যার ফলে খাদ্য গ্রহণ কমেছে।’
বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য যেসব দেশে জরিপ চালানো হয়, সেগুলো হলো আফগানিস্তান, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (ডিআরসি), ইথিওপিয়া, হাইতি, কেনিয়া, মালাউই, মিয়ানমার, নেপাল, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, সোমালিল্যান্ড, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে।