জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে আওয়ামী লীগের সাংসদ হাজি সেলিমের ১০ বছর সাজা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৬৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। হাইকোর্ট রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হাজি সেলিমকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭-এ আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
দুর্নীতির ওই মামলায় এক যুগ আগে বিচারিক আদালতের রায়ে সাংসদ হাজি সেলিমের ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাজি সেলিম হাইকোর্টে আপিল করেন। এই আপিলের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। এরপর আজ পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়।
আত্মসমর্পণ করবেন হাজী সেলিম
রায় প্রকাশের পর হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশিত রায়ে হাজি সেলিমকে এক মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। হাজি মোহাম্মদ সেলিম সাহেবের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে আমরা এক মাসের মধ্যেই বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করব। রায়ে সম্পদের তথ্য গোপনের জন্য বিচারিক আদালতের দেওয়া তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে হাজি সেলিমকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে অর্জিত সম্পত্তির ওপর যে তালিকা দুদককে দেওয়া হয়েছিল, এর বৈধ উৎস হাইকোর্ট পাননি। অথচ প্রতিবছরের আয়কর হিসাবে আয়ের উৎস উল্লেখ আছে। কিন্তু রায়ে তা আলোচনায় আসেনি, যে কারণে আপিল করা হবে।
সংসদ সদস্য পদ থাকার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, হাইকোর্ট হাজি সেলিমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তাঁর ১০ বছরের সাজা বহাল রেখেছেন। রায় অনুসারে হাজি সেলিমকে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যেতে হবে। তারপর সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল করতে পারবেন। রায়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। হাজি সেলিম ও তাঁর স্ত্রীর পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্র বরাবরে এই বাজেয়াপ্তের কাজ সম্পন্ন করবেন ডেপুটি কমিশনার।
এক প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই আইনজীবী বলেন, কারাদণ্ড বহাল থাকায় সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুসারে তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। যদি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করে হাজি সেলিম বেকসুর খালাস পান, তাহলে তখন তাঁর সংসদ সদস্য পদ ফিরে আসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকার প্রশ্নই আসে না।
অবশ্য হাজি সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে। এই আপিলের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচারে হাজি সেলিমকে দণ্ডিত বলা যাবে না। যে কারণে তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা বিষয়ে বলা আছে। অনুচ্ছেদটির ২ দফার ‘ঘ’ উপদফা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে।
হাজি সেলিমের মামলা ও রায়ের পূর্বাপর
হাজি সেলিম ও তাঁর স্ত্রী গুলশান আরার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিচারিক আদালত ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল রায় দেন। এ মামলার আরেক আসামি হাজি সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর মারা গেছেন।
২০০৭ সালে করা দুদকের মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, হাজি সেলিম জ্ঞাত আয়বহির্ভূতভাবে প্রায় ২৬ কোটি ৯২ লাখ ৮ হাজার টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়া সম্পদ বিবরণীতে প্রায় ১০ কোটি ৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। হাজি সেলিম তাঁর সম্পদ বিবরণীতে প্রায় ৫৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকার হিসাব বিবরণী দাখিল করেছিলেন।
এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারিক আদালত রায় দেন। রায়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলা হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনে হাজি সেলিমকে সহযোগিতা করার দায়ে তাঁর স্ত্রী গুলশান আরাকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এই দম্পতির অবৈধভাবে অর্জিত প্রায় ২৭ কোটি টাকার সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের আদেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাজি সেলিম এবং তাঁর স্ত্রী ২০১৩ সালে পৃথক আপিল করেন। হাজি সেলিমের আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট সাজা বাতিল করে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল বিভাগে আবেদন করে। দুদকের আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেন। সেই সঙ্গে হাইকোর্টে হাজি সেলিমের আপিলের ওপর আবার শুনানি করতে বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৩১ জানুয়ারি হাজি সেলিমের আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর করা আপিলটিও শুনানির জন্য ওঠে। হাজি সেলিম দম্পতির করা পৃথক আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত বছরের ৯ মার্চ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। হাজি সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা বেগম মারা যাওয়ায় তাঁর আপিলটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। এ মামলায় জামিনে আছেন হাজি সেলিম।
আদালতে হাজি সেলিম দম্পতির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার (প্রয়াত) ও সাঈদ আহমেদ শুনানিতে ছিলেন। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান মনির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তামান্না ফেরদৌস।