হজ বারবার থেমে গেছে মহামারি ও সংঘাতে
করোনা মহামারির কারণে এ বছর হজ হচ্ছে সীমিত আকারে। ১৯৩২ সালে বর্তমান সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি কখনো হজ বন্ধ হয়নি। তবে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্য হলো, ইতিমধ্যে ৪০ বারের মতো হজ পুরো অথবা আংশিক স্থগিত ছিল নানা সময়ে এবং নানা কারণে।
সৌদি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২ হাজার ৮১৬ জন। এই পরিপ্রেক্ষিতে এবার সৌদি সরকার সীমিত আকারে হজ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরবে বসবাসরত নানা দেশের প্রায় ১০ হাজার মুসলমান এবার হজ পালন করছেন। (আল-জাজিরা, ৩০.০৭.২০২০)
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো হজ। ফরজ ইবাদতের মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ফরজ কাজটি পালনের জন্য মুসলমানদের যেতে হয় মক্কা নগরীতে। ফলে মক্কার পবিত্র কাবা ঘর হয়ে উঠেছে মুসলমানদের প্রধান পুণ্যভূমি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় সিকি শতাংশ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ মুসলমান হজ পালন করেন। বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজারের মতো (২০১৯ সালে ১ লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ জন) মানুষ হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরব যান। বিপুলসংখ্যক মানুষের হজ পালন বিশ্ব অর্থনীতির বড় প্রভাবক। হজ এজেন্সিস অব বাংলাদেশের (হাব) তথ্যমতে, প্রতিবছর হজকে কেন্দ্র করে শুধু বাংলাদেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। অন্তত এক লাখ মানুষ হজ-সংশ্লিষ্ট নানা কাজে জড়িত থাকেন। এ থেকে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়, হজের বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্ব কতটা।
বর্তমানে যেভাবে হজ পালন করা হয়, তার বয়স প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ বছরের। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজ পালন করেন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। তারপর থেকে মুসলমানরা হজ পালন করে আসছেন।
এ বছর করোনা মহামারির কারণে অন্যান্য বছরের মতো হজ পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। সৌদি আরবে বসবাসরত দেশি-বিদেশি কিছু মানুষকে এবার হজ করতে দিচ্ছে সৌদি সরকার।
১৯৩২ সালে বর্তমান সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি কখনো হজ বন্ধ হয়নি। তবে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্য হলো, ইতিমধ্যে ৪০ বারের মতো হজ পুরো অথবা আংশিক স্থগিত ছিল নানা কারণে। কখনো যুদ্ধ, কখনো রাজনৈতিক চাল, কখনো ঘাতক মহামারির হানা, আবার কখনোবা শুধু প্রাকৃতিক বৈরিতা ছিল এর পেছনের কারণ।
হজ বন্ধ থাকার বিশেষ কয়েকটি ঘটনা
হজযাত্রীদের ওপর সাফাকের হামলা: ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইসমাইল ইবনে ইউসুফ আল-সাফাক বাগদাদের আব্বাসি সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আচমকা আরাফাতের ময়দানে হজযাত্রীদের ওপর হামলা করে। কয়েক শ হজযাত্রীর সেখানেই মৃত্যু হয়। এরপর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে সেবারের হজ বাতিল করা হয়।
কারামতীয়দের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ: মক্কা নগরীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ বলা হয় এ আক্রমণকে। ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কারামতীয়দের নেতা আবু তাহের আল-জানাবি মক্কার ওপর হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঐতিহাসিক জাহাবি তাঁর তারিখ আল-ইসলাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘৩১৬ হিজরির ঘটনার কারণে কারামতীয়দের ভয়ে সে বছর কেউ আর হজ পালন করেননি।’
আবু তাহের হজ চলাকালে কাবাগৃহের সামনে সশস্ত্র দাঁড়িয়ে থেকে তার যোদ্ধাদের দিয়ে হজযাত্রীদের নির্বিচার হত্যা করিয়েছে। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, সেদিন ৩০ হাজার হজযাত্রীকে হত্যা করে জমজম কূপে ফেলে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল কূপের পানি নষ্ট করা।
>৪০ বার পুরো বা আংশিক স্থগিত
এ বছর করোনার কারণে সীমিত আকারে হজ পালন করা হয়
রিয়াদের গবেষণা সংস্থা কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন অব রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভস তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত জার্নালে উল্লেখ করেছে, কারামতীয়রা ‘মসজিদুল হারাম’ লুট করে পবিত্র কাবা শরিফ থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথরটি নিয়ে বাহরাইনে ফিরে যায়। পরবর্তী সময়ে বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাথরটি ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত ১০ বছর হজ আদায় বন্ধ থাকে।
আব্বাসি ও ফাতেমি খেলাফতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: শুধু সংঘাত আর যুদ্ধের কারণে হজ বন্ধ থাকেনি। মুসলিম নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণেও হজ পালনে বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে ধার্মিকদের। ৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ইরাক ও সিরিয়ার আব্বাসি খেলাফত এবং মিসরের ফাতেমি খেলাফতের মধ্যে শুরু হওয়া বিরোধ মুসলমানদের হজ পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই বিরোধের আট বছর পর ৯৯১ সালে আবার আনুষ্ঠানিক হজ পালন শুরু হয়।
মারি ও মড়কের কারণে হজ বন্ধ: ৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আরও একবার মহামারির কবলে পড়ে বন্ধ থাকে হজ। ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির তাঁর আল-বিদায়া ওয়া আল-নিহায়ায় লিখেছেন, ‘৩৫৭ হিজরিতে (৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে) আল-মাশিরি নামক এক অচেনা মহামারিতে মক্কায় ব্যাপক মৃত্যু ঘটে।’ সে বছর যাঁরা হজ করতে মক্কার পথ ধরেছিলেন, তাঁদের অনেকে পথেই মারা যান। যাঁরা প্রাণে বেঁচে ছিলেন, তাঁদেরও মক্কায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে হজের মৌসুম পেরিয়ে যায়।
নিরাপত্তাহীনতা ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে: কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন অব রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভস বলছে, আনুমানিক ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে মিসরে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে এবং হজ-খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় মানুষ হজে যেতে পারেননি।
১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে মুসলমানরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং হজের সামর্থ্য হারান। ১২৫৬ থেকে ১২৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নানা সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে হেজাজের বাইরের কোনো দেশের মুসলমানরা মক্কায় পৌঁছাতে পারেননি। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে (১২১৩ হিজরি) ফরাসি বিপ্লবের সময় নিরাপত্তার খাতিরে হজের কাফেলাগুলোকে মক্কায় যেতে দেওয়া হয়নি।
তীব্র শীত ও বন্যাহেতু: ১০২৬ সালে ইরাকে তীব্র ঠান্ডা ও বন্যা শুরু হলে হজযাত্রীদের পক্ষে মক্কায় যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে হজ স্থগিত করতে হয়।
১৮৩১ সালের প্লেগ: মহামারির কারণে যে কয়বার হজ বন্ধ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ১৮৩১ সালের প্লেগ। এই প্লেগের উৎসভূমি ছিল ভারত। সেখান থেকে সংক্রমিত হয়ে বহু যাত্রী আসেন মক্কায়। প্লেগে তিন-চতুর্থাংশ হজযাত্রীর মৃত্যু হয়।
১৮৩১ সালের পর ১৮৩৭ সালে আবার মহামারি দেখা দেয়। এই প্লেগের কারণে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত লাগাতার হজ বন্ধ থাকে। মূলত ১৮২৬ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এ প্লেগ।
কলেরার কবলে মক্কা: পাঁচ বছর পর ১৮৪৬ সালে কলেরা মহামারি শুরু হয়। তাতে মক্কায় ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ মহামারি ১৮৫০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর পরেও মাঝেমধ্যেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত।
১৮৫৮ সালে আরেকটি বৈশ্বিক কলেরা মহামারি মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মত, এ মহামারি মক্কায় আসে ভারতীয় হজযাত্রীদের মাধ্যমে। ভারতীয়দের থেকে অন্যান্য দেশের হজযাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কলেরার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিসরীয় হজযাত্রীরা লোহিত সাগরের দিকে পালিয়ে যান। সেখানে তাঁদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তারপর বিরতি দিয়ে আবারও ১৮৬৫ ও ১৮৮৩ সালে ফিরে আসে কলেরা। এ জন্য বারবার হজ স্থগিত রাখতে হয়।
কাবার গিলাফের কারণে: ১৯২৫ সালে মিসর থেকে সৌদি আরবে কাবার গিলাফ বহনকারী কাফেলার ওপর হামলা হলে সে বছর মিসরের কোনো হজযাত্রী কাবাঘরে তাওয়াফ করতে যেতে পারেননি।
ইবোলা প্রাদুর্ভাব (২০১৪-২০১৬): ২০১৪ সালে সৌদি আরব সাময়িকভাবে গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনের নাগরিকদের জন্য ওমরাহ এবং হজ ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশ তিনটিতে ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১১ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। (আল-জাজিরা)
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জীবনে একটি বড় আকাঙ্ক্ষা থাকে মক্কায় গিয়ে হজ পালন ও মদিনায় নবীজির রওজা জিয়ারত করা। কিন্তু এবার বিশ্বের নানা দেশের মুসলমানদের পক্ষে প্রস্তুতি নিয়েও মহামারির কারণে হজ পালন সম্ভব হলো না। যে সৌভাগ্যবান ১০ হাজার মুসলমান হজ পালন করার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাও পবিত্র কাবাঘরকে স্পর্শ করতে পারছেন না রোগ ছড়ানোর আশঙ্কার কারণে। মুসলমানদের জীবনে আবারও স্বচ্ছন্দে হজ পালনের সুযোগ আসুক। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাঁদের এই আধ্যাত্মিক সফর আবারও নির্বিঘ্নে পালন করার সুযোগের প্রত্যাশায় রয়েছেন। এবার হাজিরা আল্লাহর কাছে এই মোনাজাতই করবেন।
সূত্র: ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়া আল-নিহায়া (বাংলা), ইফাবা, ঢাকা; শামস আল-দিন আল-যাহাবির তারিখ আল-ইসলাম, আল-রিসালা, বৈরুত; শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা, দার আল-জিল, বৈরুত; জেমস ওয়াইন ব্র্যান্ডর্টের আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সৌদি আরাবিয়া; শামস আল-দিন আল-যাহাবির সিয়ার আলাম আল-নুবালা, আল-রিসালা, বৈরুত ও কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন অব রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভস, রিয়াদ।
সালেহ ফুয়াদ: লেখক ও অনুবাদক।