সড়ক বেহাল, বার্মিজ মার্কেটে যান না পর্যটকেরা
কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকদের প্রথম আকর্ষণই সমুদ্রসৈকত। এরপর আসে ৮৪ কিলোমিটারের কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এ সড়কের এক পাশে পাহাড়ের সারি, অন্য পাশে (পশ্চিম) ১২০ কিলোমিটার বঙ্গোপসাগর। সড়কের দুই পাশে আছে পাহাড়ি ঝরনা, সাগরের জলরাশি, দর্শনীয় স্থানসহ কত কিছু।
তারপরের অবস্থান শহরের টেকপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘বার্মিজ মার্কেট’, যে মার্কেটের অন্তত ৩০০ দোকানপাট পরিচালিত হয় রাখাইন, চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের তরুণীদের মাধ্যমে। দোকানগুলোতে বেচাবিক্রি হয় রাখাইনসহ ক্ষুদ্র–জাতিগোষ্ঠীর হাতে তৈরি রকমারি পণ্য। আছে দেশি-বিদেশি পণ্যের সমাহার। পণ্যের গুণমান এবং দামে সস্তা হওয়ায় কেনাকাটার জন্য এ মার্কেটের দিকে ঝুঁকছেন পর্যটকেরা। করোনা মহামারি শুরুর আগে প্রতিটা দোকানে দৈনিক বেচাবিক্রি হতো ২০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এখন বেচাবিক্রি নেই বললে চলে।
এর কারণ জানতে চাইলে বার্মিজ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি অং ছিন রাখাইন বলেন, করোনা সংক্রমণ শুরু হলে গত বছরের মার্চ থেকে ঐতিহ্যবাহী বার্মিজ মার্কেটের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়। টানা পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দোকানপাট খোলা হয়। এ সময় কিছুদিন ব্যবসা হয়। কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে গত ১ এপ্রিল থেকে সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করলে দ্বিতীয় দফায় ১৮ আগস্ট পর্যন্ত টানা প্রায় সাড়ে চার মাস দোকানপাট বন্ধ থাকে। বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর ১৯ আগস্ট থেকে বার্মিজ মার্কেটের ৯০ শতাংশ দোকানপাট খোলা হয়। কিন্তু বেচাবিক্রি নেই। কারণ, পর্যটক নেই। এই মার্কেটের ৯০ শতাংশ ক্রেতা ভ্রমণে আসা পর্যটক।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এখন সৈকতে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম চলছে, কিন্তু বার্মিজ মার্কেটে আসা–যাওয়ার প্রধান সড়কটি ভাঙাচোরা। এ কারণে পর্যটকেরা কেনাকাটার জন্য দোকানে যেতে পারছেন না। প্রধান সড়কের পাঁচ কিলোমিটারে ছয়-সাত মাস ধরে উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। প্রধান সড়কের দুই পাশের ২০টির বেশি সড়কেরও চলছে উন্নয়নকাজ। ফলে সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, হাঁটার উপায় নেই। এতে বিপাকে পড়েছেন প্রায় ৩০০ দোকানমালিক। দোকানগুলোতে কর্মচারী আছেন প্রায় ৮০০। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৬৫০ জন রাখাইন, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায়ের তরুণী। মাসিক বেতনে তাঁরা দোকানে চাকরি করলেও বেচাবিক্রি না থাকায় ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না তাঁরা। সংকটের দিন পার করছেন তরুণীরা।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বার্মিজ মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, কেনাকাটার জন্য কেউ নেই। টেকপাড়া ম্যালেরিয়া অফিস–সংলগ্ন উম্মে বার্মিজ মার্কেটের একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে—ফাঁকা দোকানের এক কোণে বসে আছেন কর্মচারী উনু রাখাইন।
উনু রাখাইন বলেন, ‘পর্যটক নাই, তাই বেচাবিক্রিও বন্ধ। লকডাউনের কারণে এত দিন দোকান বন্ধ ছিল। ১৯ আগস্ট থেকে দোকান খুলে বসে থাকি, কিন্তু সারা দিনে ৫০০ টাকাও বিক্রি হয় না। ভাঙা সড়ক দিয়ে কেউ বার্মিজ মার্কেটে আসতে পারছেন না।’
বাজারঘাটা এলাকার করিম বার্মিজ মার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী লুমে রাখাইন বলেন, দুই দফার লকডাউনে টানা দেড় বছর দোকান বন্ধ থাকায় বহু মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ১৯ আগস্ট থেকে দোকান খোলা হলেও বেচাবিক্রি নেই। কর্মচারীদের দুই মাসের বেতন বকেয়া। বেচাবিক্রি না থাকলে বহু দোকানমালিককে পথে বসতে হবে। চাকরি হারাতে হবে বহু তরুণীকে।
দেখা গেছে, শহরের করিম বার্মিজ মার্কেট, আবু সেন্টার, সৈকত টাওয়ার, বানু প্লাজা, আমেনা শপিং কমপ্লেক্স, উম্মে বার্মিজ মার্কেট, সৌদিয়া বার্মিজ মার্কেট, আন নাহার শপিং কমপ্লেক্স, আলোছায়া শপিং কমপ্লেক্সসহ আশপাশের মার্কেটগুলোতে শতাধিক দোকান খোলা। কিন্তু কোথাও ক্রেতা চোখে পড়েনি। অধিকাংশ দোকানের কর্মচারীরা গল্পগুজব করে সময় পার করছেন।
কয়েকজন দোকানমালিক বলেন, করোনায় বন্ধের সময় অধিকাংশ দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে এনজিও এবং ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদের ঋণ নিয়ে দোকানে বিনিয়োগ করেন ব্যবসায়ীরা। এখন বেচাবিক্রি না থাকলেও ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য দোকান ও বাসাবাড়িতে চাপ আছে। কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে সংস্কারকাজ চলায় প্রায় ৩০০টি বার্মিজ পণ্যের দোকান বিপাকে পড়েছে। শতকোটি টাকার ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে দোকানমালিকদের। এখন রাস্তার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
৩০ সড়কে উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি, দুর্ভোগ
শহরের হলিডে মোড় থেকে টেকপাড়া, রুমালিয়ারছড়া হয়ে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার প্রধান সড়কের সংস্কার ও প্রশস্তকরণের কাজ চালাচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। এ সড়কের মধ্যভাগে বার্মিজ মার্কেটগুলো। কয়েক মাস ধরে সড়কে সংস্কারকাজ চললেও কাজের ধীরগতিতে অসন্তোষ মানুষের।
এ বিষয়ে কউক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, ‘২৫৮ কোটি টাকার পাঁচ কিলোমিটার সড়কের সংস্কারকাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু আমরা দেড় বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছি, দিনরাত সমানে কাজ হচ্ছে।’
এদিকে প্রধান সড়কের দুই পাশে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ২৯টি সড়কে ৩২ কিলোমিটার সংস্কারকাজ চালাচ্ছে কক্সবাজার পৌরসভা। সড়কগুলোর দুই পাশ খনন করে তৈরি হচ্ছে নালা। ফলে সড়কগুলোতে যান চলাচল দূরের কথা, ঠিকমতো হাঁটাও যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, লকডাউন ও বিধিনিষেধে পাথর ও শ্রমিকসংকট দেখা দিয়েছিল, এ কারণে কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়। তবে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সব কটি সড়কের সংস্কারকাজ শেষ হবে। তখন পৌরবাসীর দুর্ভোগ থাকবে না।