স্যামসাংয়ের পণ্য তৈরির কারখানায় চাকরি পাল্টে দিল ৮ হিজড়ার জীবন

কাজের ফাঁকে আলাপচারিতায় হিজড়ারাছবি: প্রথম আলো

অচিন্ত্য কুমারের আরেক নাম অবন্তিকা বাগচি। রোমান মোল্লা হলেন সুন্দরী রোমানা। আবদুল্লাহ আল মামুনের নাম মুন্নী জাহান। একইভাবে দেলোয়ার হোসেন বৈশাখী, মনিরুজ্জামান মনিরা, আকিব মিয়া অধরা...এভাবে একেকজনের দুটি করে নাম, দুটি করে পরিচয়। তাঁদের ভাষায়, ‘দেহ আমার পুরুষ খাঁচা, মনটি আমার নারী আত্মা, কী করে আলাদা করব আমার একই শরীরের দুটি সত্তা।’

অচিন্ত্য কুমার, রোমান মোল্লাসহ মোট আটজন হিজড়ার বর্তমান পরিচয় তাঁরা নরসিংদীর স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের কর্মী। কেউ মূল ফটকে নিরাপত্তার দেখভাল করছেন, কেউ কম্পিউটারে অফিসের নানান কাজে সহায়তা করছেন, কেউ ক্যানটিনে রান্না করছেন, কেউ কেউ হাউসকিপিংয়ের কাজ করছেন। মুখে মাস্ক এবং প্যান্ট-শার্ট পরা এই কর্মীদের চট করে অন্যদের থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। তাঁরাও চান না​ তাঁদের কেউ আলাদা চোখে দেখুক। তাঁরা গুরুমা, বাচ্চা নাচানো, শাড়ি-চুড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো, হাততালি দেওয়াসহ বিভিন্ন হিজড়া সংস্কৃতি থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করছেন।

১০ অক্টোবর স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকস কারখানায় কথা হয় অচিন্ত্য কুমারদের সঙ্গে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিলেও রোমান মোল্লাসহ অন্যরা আলাপের ফাঁকেই নিজের কাজটিও করে আসছিলেন। আলাপের শুরুতেই জানালেন, চাকরি পাওয়ার ফলে তাঁদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। চাকরি করা নিয়ে যেমন সম্মান পাচ্ছেন, তেমনি আবার নিজেদের গণ্ডী ছেড়ে আসায় কথাও শুনতে হচ্ছে।

মুঠোফোন বিক্রিতে বিশ্বব্যাপী ১ নম্বর অবস্থানে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি স্যামসাং। বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের কারিগরি সহায়তায় নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায় স্যামসাং ব্র্যান্ডের মুঠোফোন সংযোজনের কারখানা করেছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। ২০১৮ সালের জুনে যাত্রা শুরু করা কারখানাটি প্রায় ৫৫ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। এ কারখানায় স্যামসাংয়ের মুঠোফোনের পাশাপাশি ফ্রিজ, টেলিভিশন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি), মাইক্রোওয়েভ ওভেনও তৈরি হচ্ছে। ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের অত্যাধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টে কাজ করছেন প্রায় ১ হাজার ৮৬০ কর্মী। যার মধ্যে নারী ৭৫০ জন। এই কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছেন আটজন হিজড়া।
স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের চিফ অপারেটিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আকরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে মোট আটজন হিজড়া ক্যানটিন, অফিস, হাউসকিপিংসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন, আস্তে আস্তে তাঁদের কারখানার বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজেও লাগানো হবে। আর হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার কর্মীর সংখ্যাটা ধীরে ধীরে ১০০ জন করার পরিকল্পনা আছে।
কারখানার হিজড়া কর্মীরা জানালেন, তাঁরা বেসরকারি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মধ্যস্থতায় কারখানাটিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁরা জীবন পরিবর্তনের এ সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন।

গত ৩ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে হিজড়াদের চাকরি দিলে বিশেষ করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তার মোট কর্মচারীর ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি হিজড়াকে নিয়োগ দেয়, তবে ওই কর্মচারীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা প্রদেয় করের ৫ শতাংশ, যেটি কম, তা নিয়োগকারীকে কর রেয়াত হিসেবে প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কর্মক্ষম এ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে পারলে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে বলেও অর্থমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারদের জীবনমান উন্নয়নে দেশে কাজ করছে ১৯৯৬ সাল থেকে। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হিজড়াদের নিয়োগে কর রেয়াতের সরকারের ঘোষণার পর স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকস প্রথম বড় প্রতিষ্ঠান, যারা একসঙ্গে আটজন হিজড়াকে নিয়োগ দিয়েছে। সরকারের উদ্যোগ বা ঘোষণা থাকলে বেসরকারি সংগঠন এগিয়ে আসে, কাজটা দ্রুত ও কার্যকর হয়, তার প্রমাণ একসঙ্গে আটজন হিজড়ার নিয়োগ। কারখানাটির ঢাকা অফিসের জন্য ১০ জন হিজড়াকে নিয়োগ দেওয়ার কথা হচ্ছে। নিয়োগপ্রক্রিয়া ও নিয়োগের পর কারখানার অন্য কর্মীদের জেন্ডারবিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজনসহ বিভিন্নভাবে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সহায়তা করছে।

বড় কারখানায় হিজড়াদের নিয়োগ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন সালেহ আহমেদ। তিনি বললেন, সমাজের স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে হিজড়াদের বাড়িভাড়া পাওয়া থেকে শুরু করে প্রতি পদেই অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। তাই প্রতিষ্ঠান যে বেতন দেয়, তা–ও হিজড়াদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তবে প্রক্রিয়াটা একবার শুরু হলে তখন অন্যান্য সমস্যা আস্তে আস্তে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

নরসিংদীর স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের কারখানার ফটকের সামনে পাঁচ হিজড়া
ছবি: প্রথম আলো

অচিন্ত্য কুমার নরসিংদী সরকারি কলেজের বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। বর্তমান পরিচয় তিনি স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের সিও অফিসের অফিস সহকারী। তাঁর বাবা কৃষিকাজ করেন। আগে ছিলেন তিন বোন, এখন অচিন্ত্য নিজেকে নারী হিসেবে দেখেন, তাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন আমরা চার বোন।’

অচিন্ত্য কুমার এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছেন। এখনো তাঁর রেজাল্ট ভালো। জানালেন, তাঁর গুরুমা আছেন। বাচ্চা নাচিয়েছেন। তবে বাজারে গিয়ে কখনো চাঁদা তোলেননি। চাকরি প্রসঙ্গে বললেন, ‘প্রথম দিকে দ্বিধা ছিল। সবাই মিশবে কি না বা কটু কথা শোনাবে কি না, তা নিয়ে ভয় ছিল। আমাদের তো আর সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না। তবে এখানে ব্যতিক্রম, সবাই আমার বা আমাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন।’

রোমান মোল্লা নরসিংদী সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী। পরিবার মেনে নিতে চায়নি বলে ১০ বছর ধরে তিনি পরিবার থেকে আলাদা থাকছেন। একবার গিয়েছিলেন বাড়িতে, এতে তাঁর বোনের বিয়ে ভেঙে যায়। এর আগে তিনি জাতীয় সংসদে দেড় বছর হাউসকিপিংয়ে কাজ করেছেন, ভাগ্য পরিবর্তনে আট লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরবেও গিয়েছিলেন, তবে ১১ মাসের মাথায় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। বললেন, ‘সম্মান পেলে অবশ্যই চাকরি করা যাবে।’

আবদুল্লাহ আল মামুন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। অ্যাডমিন সহকারী হিসেবে তিনি কাজ করেন। তিনিও বললেন, ‘স্যামসাংয়ে চাকরি করি, বাইরে যখন এ কথা বলি, তখন অন্যরা সম্মান দেয়।’

দেলোয়ার হোসেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ করেছেন। তিনি বর্তমানে হাউসকিপিংয়ে কাজ করছেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে এর আগে ছয় বছর চাকরি করেছেন। তিনিও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছেন। পকেট থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে পাওয়া পরিচয়পত্রটি দেখালেন। বললেন, ‘আমরা তো এই সমাজে লিঙ্গপ্রতিবন্ধী। সমাজের কাছ থেকে পাওয়া অতিরিক্ত অত্যাচারে আমাদের অনেকেও জুলুমকারী হিসেবে চিহ্নিত হন। রাস্তাঘাটে ভয়ে মানুষ আমাদের ১০-২০ টাকা দিয়ে দেন। আমাদেরও তো পেট আছে। কাপড় লাগে। থাকার ঘর লাগে।’

মনিরুজ্জামান স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের ক্যানটিনে রান্না করেন। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তানভির মিয়াও এমএ করে বর্তমানে ক্যানটিনে কাজ করছেন।

চাকরি বদলে দিয়েছে এই হিজড়াদের জীবন
ছবি: প্রথম আলো

হিজড়া আটজনের মধ্যে ছয়জনই কাজ করছেন স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের ফ্যাক্টরি অ্যাডমিন নীপা আজাদের অধীনে। তিনি বললেন, ‘এখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে একটু ভালো ব্যবহার করলেই তাঁরা তাঁদের দুঃখের কথা শেয়ার করেন। এখানে সবাই মিলেমিশে কাজ করছেন। চাকরি পাওয়ার ফলে তাঁদের নিত্য রুটিনে ব্যাঘাত ঘটেছে। সকাল আটটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত নিয়মের মধ্যে থেকে কাজ করতে হচ্ছে। নানান প্রশিক্ষণ চলছে। অন্য কর্মীদের কেউ যদি তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, তবে ওই কর্মীর চাকরি চলে যাবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো।’

হিজড়া কর্মীরা জানালেন, কারখানায় তাঁরা মোট ১২ জন নিয়োগ পেয়েছিলেন। নিয়মকানুন মানতে না পারায় কয়েকজন কাজে যোগ দিয়েও পরে আর আসেননি। আটজনের মধ্যে একজন এখনো অনিয়মিত। তাঁরা প্রশিক্ষণকালে আট হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ পেয়েছেন। পরে বেতন আরও বাড়বে। তাঁদের খরচ যেহেতু অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি, সেই দিক কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করলে চাকরিতে তাঁদের টিকে থাকাটা সহজ হবে বলে মনে করেন তাঁরা।