বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০২২
স্বাস্থ্য জনবলে পিছিয়ে বাংলাদেশ
স্বাস্থ্য খাতের প্রায় সব বিষয়ের পরিসংখ্যান এই প্রতিবেদনে আছে। নীতিনির্ধারক ও কর্মসূচি বাস্তবায়নকারীদের কাজে লাগবে।
এক হাজার মানুষের জন্য চারজনের বেশি চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ থাকা দরকার। বাংলাদেশে আছে একজনের সামান্য বেশি। স্বাস্থ্য খাতের নানা সূচক নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য জনবল নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০২২ নামের এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবার জনবলে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই জনবলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সবার ওপর রয়েছে মালদ্বীপ।
গতকাল রোববার জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে ৭৫তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনের এক দিন আগে স্বাস্থ্য খাতের পরিসংখ্যান নিয়ে এই বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মূলত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অবকাঠামো বা আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকাই যথেষ্ট নয়। সেগুলো কার্যকরভাবে চালু রাখার জন্য পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল থাকা জরুরি। এসডিজি অর্জনের জন্য তৈরি করা জনবল কৌশলপত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, এক হাজার মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য ৪ দশমিক ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ দরকার। বাংলাদেশে এক হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন শূন্য দশমিক ৬৭ জন। আর এক হাজার মানুষের জন্য নার্স ও মিডওয়াইফ আছেন শূন্য দশমিক ৪৯ জন। এক হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ আছেন ১ দশমিক ১৬ জন। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে ৭৪ শতাংশ চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ কম আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড–১৯ মহামারির সময় অনেক চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্য এখানে অনুপস্থিত। আমাদের জনবলের ঘাটতি আছে ঠিকই। তবে ২০৩০ সালের আগে আমরা সেই ঘাটতি প্রায় পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারব।’
প্রতিবেদনে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যবিধি, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ, টিকাসহ ৫০টির বেশি সূচকের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় অনিরাপদ পানিসংশ্লিষ্ট সমস্যার কারণে। পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় বিষক্রিয়ায়। সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন রোগের মৃত্যুর তথ্যও প্রতিবেদনে আছে।
অন্যের হাতে মৃত্যুর তথ্যও প্রতিবেদনে এসেছে। দেশে এক লাখ মানুষের মধ্যে বছরে ২ দশমিক ৮ জন খুন হয় অন্যের হাতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ। সেই হিসাবে বছরে ৪ হাজার ৭৬৮ জন মানুষ অন্যের হাতে খুন হচ্ছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১৩ জন মানুষ অন্যের হাতে মারা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার সূচক অনুযায়ী সেবার আওতায় আছে। এর অর্থ দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পায়। এর অন্য অর্থ হচ্ছে ৪৯ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পায় না। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, ২৪ শতাংশ মানুষের পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খরচ মেটাতে। ৮ শতাংশের বেশি মানুষ পারিবারিক আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি খরচ করে চিকিৎসার পেছনে। কয়েক বছর ধরে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলে আসছেন, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিসংখ্যান দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সুতরাং এর আলাদা গুরুত্ব আছে। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা বুঝতে পারছি, কোথায় অগ্রগতি হচ্ছে, কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। নীতি নির্ধারণ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এই পরিসংখ্যান বিশেষভাবে কাজে লাগবে।’