শিল্পের আবেদনবাহী প্রতিবাদী পোস্টার

মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক প্রবল সৃষ্টিশীল সময়। গানে, কবিতায়, ছবি আঁকায়, সিনেমায় বাঙালির সৃজনশীলতার শতমুখী স্ফুরণ ঘটেছিল ওই উত্তাল সময়েও। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে আঁকা পোস্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী, সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল ও সবচেয়ে শিল্পোৎকর্ষমণ্ডিত ছিল কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার মুখাবয়বের ব্যঙ্গচিত্র, যাতে পরিস্ফুটিত হয়েছিল ওই চরিত্রের হিংস্র ও দানবীয় রূপ। পোস্টারটির ওপরে লেখা ছিল ‘এই জানোয়ারদের’ আর নিচে ছিল ‘হত্যা করতে হবে’ শব্দগুচ্ছ।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনী যে নির্মম গণহত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারীর প্রতি নিগ্রহযজ্ঞ চালায়, তার মূল নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তানের খোদ প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ জেনারেল ইয়াহিয়া। সুতরাং শিল্পী কামরুল হাসান তাঁর ব্যঙ্গাকৃতির মুখাবয়বে ফুটিয়ে তোলেন ১৯৭১-এর সব নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও ধ্বংসের প্রতীকী রূপ। মুক্তিযুদ্ধের মতো এক বিশাল প্রতিরোধযজ্ঞে একটি পোস্টার বা একটি শিল্পকর্মও কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, এটাই তার বাস্তব প্রমাণ। রাজনৈতিক তাৎপর্যের বিশেষত্ব ছাড়াও অঙ্কিত চিত্রটি নান্দনিক পরিশীলনে উন্নত শিল্পকর্মের মর্যাদায় ভূষিত।

এই পোস্টার ১৯৭১ সালের মে মাসে প্রথমে কলকাতা থেকে জয় বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর ওই মাসেই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এক রঙে এর লক্ষাধিক কপি ছাপিয়ে মুক্তাঞ্চলে বিলি করে। কিছুদিন পরে বিদেশিদের উদ্দেশে প্রচারিত এই পোস্টারের ইংরেজি ভাষ্যের বক্তব্য ছিল: Annihilate the Demons।

শিল্পী কামরুল হাসান তখন প্রবাসী সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে গড়ে ওঠা আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের পরিচালক। এই বিভাগের দপ্তর ছিল কলকাতার সার্কুলার রোডে। তাঁর অধীনে দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, নাসির বিশ্বাস, বীরেন সোমের মতো শিল্পীরা ছিলেন ডিজাইনার হিসেবে। আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার তথা মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে পোস্টার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানসহ প্রত্যেকেই আঁকেন এক বা একাধিক পোস্টার। এটি ছাড়া কামরুল হাসানের আরেকটি পোস্টার ছিল মুক্তিযোদ্ধার চিত্রসংবলিত, যার বক্তব্য ছিল: ‘ভয় নেই আশেপাশেই মুক্তিযোদ্ধা’। দেবদাস চক্রবর্তীর আঁকা পোস্টারের ভাষা ছিল: ‘বাংলার হিন্দু/বাংলার খৃষ্টান/বাংলার বৌদ্ধ/বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই/বাঙালী’। নিতুন কুন্ডুর আঁকা পোস্টারের বক্তব্য: ‘সদাজাগ্রত/বাংলার/মুক্তিবাহিনী’। প্রাণেশ মণ্ডলের আঁকা পোস্টারের কথা: ‘বাংলার/মায়েরা/মেয়েরা/সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। প্রতিটি পোস্টার একাধিকবার এঁকে সম্মিলিত আলোচনার পর তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিল্পী কামরুল হাসানও একাধিক খসড়া এঁকে ও তিন-চারবার পরিবর্তন করে আলোচ্য পোস্টারটির চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন।

শুধু কলকাতায় অবস্থানকালেই বা ২৫ মার্চের পরবর্তী কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই যে কামরুল হাসান ইয়াহিয়ার এমন দানব মূর্তির কল্পনা করেছিলেন তা নয়, উত্তাল মার্চে ঢাকায় অবস্থানকালেই তিনি ইয়াহিয়ার এমন রূপ চিত্রিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা জাদুঘরের কোনো এক অনুষ্ঠানে তিনি ইয়াহিয়াকে সামনাসামনি দেখেন এবং প্রথম দেখাতেই ইয়াহিয়াকে তাঁর কাছে ডেভিলের মতো মনে হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তিনি পোস্টারের জন্য ইয়াহিয়ার অনেকগুলো স্কেচ করেন এবং ২৩ মার্চ ওই সব স্কেচসংবলিত অন্তত দশটি পোস্টার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে টাঙিয়ে দেন। ওই পোস্টারের ভাষা ছিল, ‘এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে।’

মুক্তিযুদ্ধের এই পোস্টার শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের বা সাধারণ মানুষকেই যে অনুপ্রাণিত করেছে বা শত্রুর প্রতি ঘৃণাবোধে জাগ্রত করেছে তা না, শিল্পী, লেখক, বুদ্ধিজীবী মহলও এর শৈল্পিক শক্তি নিয়ে ছিলেন সচেতন ও প্রশংসামুখর। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ভাষায়, ‘দানবরূপী ইয়াহিয়া খানের সেই মুখাবয়ব বাঙালিদের কাছে বর্গীর মতোই চিরজাগরূক থাকবে।’ ত্রৈমাসিক সম্পাদক মীজানুর রহমান লিখেছেন, ‘ওঁর আঁকা বিখ্যাত ছবি “এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে” মুক্তিযুদ্ধে যে কত বড় মারণাস্ত্রের কাজ করেছিল, সে কথা নিশ্চয় আজ নতুন করে ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।’

কামরুল হাসানের আঁকা এই পোস্টার শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ ও শাণিত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল তা নয়, সৃষ্টিসৌকর্যে আর কল্পনার উচ্চতা ও উৎকর্ষে এটি সর্বকালের আবেদনবাহী এক প্রতিবাদী শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।