
১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি কুষ্টিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের (ইবিআর) আওতায় এই সম্প্রসারণ ঘটে। রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোয়ালন্দের অবস্থানগত গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়, যা প্রকাশিত হয়েছে সেকালের পত্রপত্রিকাতেও।
১০ জানুয়ারি ১৮৭৫ সাধারণীর সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘পূর্ব্বে গোয়ালন্দ একটি যৎসামান্য গ্রাম ছিল। এখন রেলওয়ে ষ্টেশন হইয়া অতি বিখ্যাত স্থান হইয়াছে। উত্তর, পূর্ব্ব-বাঙ্গালা ও আসাম অঞ্চলের লোকদিগকে কলিকাতা অঞ্চলে যাইতে হইলে এস্থানে আসিয়া রেল গাড়ীতে উঠিতে হয়। বাণিজ্য উপলক্ষে বহুতর বণিক মহাজনের এখানে সমাগম হইয়া থাকে।’ যাত্রীসংখ্যা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ১৮৭৪ সালে শুধু তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা রুটে রিটার্ন টিকেট প্রবর্তন করে।

আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের (এবিআর) আওতায় চাঁদপুর ঘাট স্টেশন উদ্বোধন হয় ১ জুলাই ১৮৯৫। এতে চাঁদপুর ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পারাপার সম্ভব হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, সিলেট, আসামের যাত্রী গোয়ালন্দ ঘাট দিয়ে কলকাতায় যাতায়াত শুরু করে। বড় বড় নদীর উপস্থিতির কারণে পূর্ব বাংলার অনেক স্থানেই সরাসরি রেললাইন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে সেসব স্থানে সেতু তৈরি করাও সম্ভবপর ছিল না। সে কারণে স্টিমার এবং ওয়াগন ফেরির মাধ্যমে নদীর দুই পাড়ে অবস্থিত রেলপথকে সংযুক্ত করা হয়। এমনি ধরনের কয়েকটি ঘাটস্টেশনের মাধ্যমে ইবিআর-এবিআর অভ্যন্তরীণ যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করে তুলতে চেষ্টা করে। যেসব স্টেশন দিয়ে সর্বাধিক মালামাল ও যাত্রী পরিবহন হতো সেগুলো হলো, নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ-চাঁদপুর, বাহাদুরাবাদ-তিস্তামুখ এবং জগন্নাথগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ঘাট। ‘দ্য ফেরি এরেঞ্জেমন্টস অ্যাট সারা ঘাট’ প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ইবিআর এর অন্তর্ভুক্ত একটি বড় স্টিমার ও দুইখানা টাগ স্টিমারের সাহায্যে ঢাকা ও গোয়ালন্দের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা হতো। এর মধ্যে প্রিন্সেস এলিস নামক স্টিমারটি সে সময় অতি উচ্চমানের এবং বিলাসবহুল ছিল।
আসাম বেঙ্গল রেলওয়েও নিজস্ব স্টিমার সার্ভিসের সাহায্যে চাঁদপুর, গোয়ালন্দ দিয়ে কলকাতা পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যিক কাজ পরিচালনা করত। রেলওয়ের ‘জুট স্পেশাল’ স্টিমার সিরাজগঞ্জ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত চলাচল করত। ফলে স্টিমার কোম্পানিগুলো আগে যেভাবে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে আসছিল রেলওয়ে আসার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
রেলওয়েতে তখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কামরা ছাড়াও মাল পরিবহনের জন্য একটি বিশেষ বগি বা কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল। এস সি ঘোষের (১৯১৮) লেখা ‘আ মনোগ্রাফ অন ইন্ডিয়া রেলওয়ে রেইটস’ গ্রন্থে পণ্য পরিবহন খরচের একটা চিত্র পাওয়া যায়। ধান ও অন্যান্য শস্যবীজের জন্য ভাড়ার হার নির্ধারিত হতো মণ ও মাইলের হিসাবে। ঋতুভিত্তিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করা হতো। আর বিশেষ ক্ষেত্রে ভাড়ার হার পরিবর্তিত হত। তবে সাধারণত স্টিমার কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হতো। ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন ঘাট স্টেশন থেকে গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতায় যে পাট রপ্তানি করা হতো বছরের বিভিন্ন সময়ে তার পরিবহন ব্যয় ছিল নিম্নরূপ—

পড়তি সময় বলতে বর্ষাকালকে বোঝানো হয়েছে। এ সময় নদীপথে পণ্য পরিবহন সহজ হতো। ফলে রেলওয়ে মাল পরিবহনের ভাড়াও কমিয়ে দিত। মধ্যম সময় বলতে বোঝায় রেলওয়ের স্বাভাবিক পরিবহন। ব্যস্ত সময় বলতে রেলের একচেটিয়া পাট পরিবহনকে বোঝানো হয়েছে। কেননা এ সময় নদীগুলোর পানি অনেকাংশেই শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা রেলের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে পাট রপ্তানি করত। ফলে রেলওয়ে শুকনো মৌসুমে অন্যান্য সময়ের কম ভাড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিত।

লিখিত অনেক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ঘাটস্টেশনগুলোর মাধ্যমে চা-পাটসহ বিবিধ পণ্য পরিবহন নিয়ে রেল কোম্পানির সঙ্গে স্টিমার কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হতো প্রায়ই। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স এবং রেলওয়ে বোর্ড উভয়কে সমঝোতার ভিত্তিতে চলার পরামর্শ দিত। ১৮৮৯ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে আইজিএসএন ও আরএসএন জয়েন্ট স্টিমার কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অনেক কাজ যৌথভাবে করলেও সেগুলো ছিল পৃথক ব্যবস্থাপনাতেই। ১৮৯০–এর দশকে আইজিএসএনের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৫৫টি স্টিমার, ৯৬টি ফ্লাট এবং আরএসএসের অধীনে ছিল ৪২টি স্টিমার ও ৮৪টি ফ্লাট।
আইজিএসএন শুরুতে নেভিগেশন কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ১৮৯৯ সালে রেল কোম্পানি হিসেবে রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়ে ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়েজ কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, বি সি এলেনের (১৯১২) তথ্য মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ডেসপাচ স্টিমারের সময় লাগত ছয় ঘণ্টা। আর ধীরগতির স্টিমারগুলো ১৫ ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারত। এই ধীরগতির স্টিমারগুলো কমলা ঘাট, ষাটনল, বাহার, সুরেশ্বর, তারপাশা (লৌহজং), মাওয়া, কাদিরপুর (ভাগ্যকুল), নারিসা, মৈনট, জালালদি, কেননাপুর ও গোয়ালন্দ যেত। নেভিগেশন কোম্পানিগুলো কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ প্লেজার ট্রিপেরও ব্যবস্থা করত সময় সময়।

শুধু নেভিগেশন কোম্পানিগুলোই নয়, রেল কোম্পানিগুলোও বিশেষ উপলক্ষে রেল ভ্রমণের ব্যবস্থা করত। জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে সমন্বয় করে রেলকে জনপ্রিয় করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে রেল কর্তৃপক্ষ। দিনাক সোহানী কবিরের লেখা ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পূজা উপলক্ষে ছিল এই বিশেষ ব্যবস্থা। গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১২৮ মাইল দূরত্বের জন্য নামমাত্র ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। মাথাপিছু চার টাকা মাত্র। এই বিশেষ ট্রেনটি চারটি স্টেশনে থামার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ছাড়া কলকাতা পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া, প্রধান দর্শনীয় স্থানের জন্য গেটের ভাড়া, কালীঘাটের জন্য পূজার ফি, রেলওয়ে নির্মিত নিজস্ব সিনেমার একটি টিকিট ছাড়াও তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য, উক্ত ট্রেনে যে ৬৩৯ জন যাত্রী ভ্রমণ করে, তন্মধ্যে ৬১৯ জন ইতিপূর্বে কখনো কলকাতায় যায়নি এবং ১৩০ জনের সেটাই ছিল প্রথম রেলযাত্রা। ১৯২৭ সালের পর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে পূজা উপলক্ষে এই ট্রেনের যাত্রা অব্যাহত থাকে। ইত্যবসরে ব্রিটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তান আমল কেটেছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর সেই তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন, সিনেমার টিকিট আর তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার এখন শুধুই স্মৃতি। (চলবে..)

আরও পড়ুন:
সমাজ-সাহিত্যে গোয়ালন্দ ঘাট- ২