বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদার (৪২) হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল বুধবার রাজধানীতে র্যাবের সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের কর্মকর্তারা বলেছেন, শাশুড়ি ও স্ত্রীর বড় বোনের সঙ্গে জোর করে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
রফিকুল ইসলাম ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। তিনি বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা এবং ঢাকা মহানগর কমপ্লেক্সের ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। ঢাকা মহানগর কমপ্লেক্সের জমি নিয়ে কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপার আনন্দনগর গ্রামে। গত ৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে নয়টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার আদাবাড়িয়ার একটি পেঁয়াজখেতে হাতকড়া পরা অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও রফিকুলের স্বজনেরা তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছিলেন। লাশ পাওয়ার দুই ঘণ্টা আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে র্যাব পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে ধরে নিয়ে যান। বিষয়টি তখন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।
রফিকুল হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনকে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। এ সময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এ টি এম হাবিবুর রহমান, গোয়েন্দা শাখার পরিচালক জিয়াউল আহসানসহ মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
র্যাবের দাবি, শাশুড়ি লিপি বেগম (৪৪) দুই লাখ টাকায় লোক ভাড়া করে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার অন্য তিনজন হলেন মোহাম্মদ আলী ওরফে মোহাব্বত (৩৬), ফজলুর রহমান (৫৩) ও মিজানুর রহমান ওরফে মন্টু (৪১)। গত মঙ্গলবার ও গতকাল ভোর পর্যন্ত ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে র্যাব জানায়। ফজলুর রহমান পুলিশের কনস্টেবল ও র্যাবের সাবেক সদস্য। তিনি তিন বছরের মতো রাজধানীর র্যাব-৩-এ কর্মরত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা জাসদের প্রচার সম্পাদক। আর মিজানুর রহমান কুষ্টিয়া সদরের ঝাউদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি চরমপন্থী দলের সঙ্গে জড়িত বলে র্যাব জানিয়েছে। তবে তাঁদের স্বজনদের দাবি, আগেই তাঁদের ধরা বা অপহরণ করা হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, খুব অল্প সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ফুটপাতের ব্যবসায়ী থেকে অগাধ টাকার মালিক হন রফিকুল। বিভিন্ন খারাপ নেশায় আসক্তির কারণে তাঁর প্রথম স্ত্রী ছেড়ে যান। পরে ২০০৭ সালে ঝরা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। কিছুদিন পরই তিনি জোর করে শাশুড়ি লিপি বেগম ও স্ত্রীর বড় বোনের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রফিকুল তাঁর শাশুড়িকে ঝিনাইদহের আনন্দনগরে একটি বাড়ি কিনে দেন। এই বাড়ি থেকেই অপহূত হন রফিকুল।
লিপি বেগম সাংবাদিকদের বলেন, রফিকুলের হাতে-পায়ে ধরেও তিনি এই সম্পর্ক থেকে ফেরাতে পারেননি। নিষেধ করলেই তাঁর মেয়েকে (ঝরাকে) মেরে ফেলার হুমকি দিত রফিকুল। তাই তিনি জামাইকে ভয়-ভীতি দেখানোর জন্য দুই লাখ টাকা দিয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে চুক্তি করেন। লিপির দাবি, হত্যার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাঁর। তিনি চেয়েছিলেন ভয় দেখিয়ে রফিকুলকে ঝিনাইদহ থেকে দূরে রাখতে।
র্যাবের উপস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী জানান, লিপি বেগমের ভাই মশিউর রহমান ওরফে মধু তাঁর বন্ধু ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে জাসদের রাজনীতি করতেন। ২০১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ মশিউর নিহত হন। নিহত বন্ধুর ছেলেমেয়েদের খোঁজ নিতে তিনি মাঝে মাঝে লিপির বাড়িতে যেতেন। গত জানুয়ারি মাসে লিপি তাঁর ‘ছোট জামাই’ (রফিকুল) বিষয়ক সমস্যার কথা বলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয় তোতা নামের একজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানান মোহাম্মদ আলী। তোতা এক লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁর সঙ্গে রফিকুলকে ধরতে যেতে রাজি হন। এরপর তাঁরা ফজলুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে ফজলুর তখন বাড়িতেই ছিলেন। হাতকড়া জোগান দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কায়দা-কানুন শেখানোর দায়িত্ব ছিল ফজলুরের।
মোহাম্মদ আলী বলেন, সোহেল রানা নামের এক তরুণের মাধ্যমে লিপি তাঁকে বলে পাঠান যে র্যাব সেজে সন্ত্রাসী ধরতে তাঁরা বাড়িতে ঢুকবেন। লিপি যাকে ‘ছোট জামাই’ হিসেবে সম্বোধন করবেন, তাঁকেই ধরে নিয়ে আসবেন তাঁরা। সে অনুযায়ী তাঁরা রফিকুলকে ধরে মাইক্রোবাসে কুমারখালীর আদাবাড়িয়ার একটি পেঁয়াজখেতে নিয়ে যান। কিন্তু রফিকুল চিৎকার করলে গ্রামবাসী টর্চ হাতে বের হয়ে শোরগোল শুরু করেন। সেখানেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। তাঁরা হাতকড়া পরা অবস্থাতেই তাঁকে রেখে পালিয়ে যান।
এ ঘটনার সঙ্গে খেলাফত, শিমুল, সোহেল রানা, মধু ওরফে মন্টু, তোতাসহ আরও কয়েকজন জড়িত বলে র্যাব জানিয়েছে।
গ্রেপ্তার চারজনকে গতকাল টেলিভিশন চ্যানেলে দেখে অবাক হয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা। স্বজনেরা জানান, গত ২৫ জানুয়ারি খুলনার গ্যারিসন সিনেমা হলের সামনে থেকে র্যাব পরিচয়ে মোহাম্মদ আলীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় ২৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার স্থানীয় একটি পত্রিকা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর স্ত্রী ময়না বেগম। এ বিষয়ে খুলনার খান জাহান আলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
লিপি বেগমের একজন স্বজন জানান, গত ৩০ মে ভ্যানে করে শেখপাড়া বাজার থেকে আনন্দনগরের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তায় মাইক্রোবাসে করে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন ব্যক্তি লিপিকে ধরে নিয়ে যান। এরপর তাঁরা নানা জায়গায় খুঁজেছেন, থানায়ও গিয়েছেন। তবে থানা কোনো জিডি বা মামলা নেয়নি। লিপির ওই আত্মীয় বলেন, ‘হত্যা মামলা করে আমরা মহাবিপদে পড়েছি। আর কিছু বলতে চাই না।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর ১৫ দিন আগে নিখোঁজ হন বলে দাবি করেছেন তাঁর স্বজনেরা।