যৌন হয়রানি: ৯৯৯ নম্বরে দিনে ৫ কল
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন (ছদ্মনাম)। ১২ জুন ভোরে তিনি জিগাতলা এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরার জন্য ছুটছিলেন।
হঠাৎ এক ব্যক্তি শারমিনকে জাপটে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ওই ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে লোকজন ধাওয়া করে ওই ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন।
শারমিন তাঁর বাবাকে ফোন করে ঘটনাস্থলে ডেকে আনেন। তিনি এসে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’-এ ফোন করে সহায়তা চান। ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ওই ব্যক্তিকে আটক করে। আটক ব্যক্তির নাম মাহবুব মোর্শেদ (২৬)। পরে তাঁর নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়।
প্রায় একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে ৯ জুন সকালে, নড়াইলে। এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এক নারী ৯৯৯ নম্বরে কল করেন। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্কুলে যাওয়ার পথে কয়েকজন বখাটে তরুণ তাঁর মেয়ের পথরোধ করে তাকে উত্ত্যক্ত করেছে।
ফোন পেয়ে নড়াইল সদর থানার পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। তারা ইজাজুল (১৯), মিরাজুল (২৩) ও ইসমাইল (২০) নামের তিন তরুণকে আটক করে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত মিরাজুলকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন। বাকি দুজনকে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর (৯৯৯) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় ফোনকলের সংখ্যা বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে এমন অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে দিনে গড়ে পাঁচটি ফোনকল ৯৯৯ নম্বরে এসেছে। ফোনকলের এই হার আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি।
পাঁচ মাসে ৭০৩ কল
৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে সারা দেশ থেকে ৮ হাজার ৪২টি ফোনকল এসেছে। তার মধ্যে যৌন হয়রানি-উত্ত্যক্তের প্রতিকার চেয়ে কল এসেছে ৭০৩টি।
২০২১ সালে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় ১২ হাজার ১৬৯টি কল এসেছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ৭১টি কল এসেছিল যৌন হয়রানির ঘটনায়। ২০২০ সালে ৯৯৯ নম্বরে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ৬ হাজার ৩৩১টি কল এসেছিল। তার মধ্যে ৮৯৫টি ছিল যৌন হয়রানিবিষয়ক।
২০১৯ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ৩ হাজার ১১৫টি কল আসে। তার মধ্যে ৭৩১টি যৌন হয়রানির ঘটনায়। ২০১৮ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগে ২ হাজার ২৯২টি কল আসে। এর মধ্যে ৬৯২টি কর ছিল যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে।
প্রতিকার চেয়ে ফোন
৯৯৯-এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, পথেঘাটে নারীদের উত্ত্যক্ত করাকে গুরুতর যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন উচ্চ আদালত। ৯৯৯ নম্বরে যৌন হয়রানি-উত্ত্যক্তের প্রতিকার চেয়ে কল এলে ঘটনাটি দ্রুত সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে অবহিত করা হয়। থানা থেকে ঘটনাস্থলে পুলিশ যায়। তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১০ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যৌনকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নিজের অঙ্গ বা বস্তু দিয়ে নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে, কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করলে, সেই কাজ যৌনপীড়ন হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩ থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৬ ধারায় ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ৯৯৯ নম্বরে এ ধরনের অভিযোগে ফোনকলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আনোয়ার সাত্তার বলেন, কলের সংখ্যা বেড়েছে মানে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়ে গেছে, সেটা বলা যায় না। মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে। তাই তারা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে প্রতিকার চাইছে। ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে যে প্রতিকার পাওয়া যায়, সে তথ্য মানুষ বেশি করে জানছে। তাই দিন দিন এখানে ফোনকলের সংখ্যাও বাড়ছে। পথেঘাটে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই এখন ৯৯৯ নম্বরে ফোন করছেন।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর (৯৯৯) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে ৯৯৯ নম্বরে ভুক্তভোগী, তাঁদের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এমনকি এলাকাবাসী বা পথচারীরা ফোন করছেন।
পথে যৌন হয়রানি বাড়ছে
পথেঘাটে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে জানান ‘আমরাই পারি’ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক। তবে সব ঘটনা সামনে আসছে না। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে পথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কয়েকটি ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী সমাবেশ।
৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন বেসরকারি রেডিও স্টেশনে কর্মরত এক নারী। তাঁর ভাষ্য, তিনি রিকশায় করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে যৌন হয়রানির শিকার হন। পেছন থেকে এক ব্যক্তি তাঁর জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দ্রুত পালিয়ে যান। ওই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে বসা ছিলেন।
ঘটনাটি নিয়ে ভুক্তভোগী নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘আশপাশে একটা পুলিশ নাই, একটা মানুষও এসে ধরল না আমার চিৎকার শুনে। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না। আমার শরীর এখনো কাঁপতেছে ভয়ে। আমার সঙ্গে এমনটা হলো কেন? কখনো ভাবি নাই ঢাকা শহরে আমার সঙ্গে এমন কিছু ঘটতে পারে। একটা মানুষ আগায় আসলো না। একটা মানুষও না।’
গত ১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে যৌন হয়রানির শিকার হন এক তরুণী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে, তাতে তিনি হতবাক। তিনি আরও বেশি হতবাক হয়েছেন, ঘটনার সময় একজন ভিক্ষুক ছাড়া আর কারও প্রতিবাদ না করার বিষয়ে।
দরকার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ
‘আমরাই পারি’ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক মনে করেন, পথেঘাটে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ হওয়া দরকার। এ জন্য তিনি সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এসব ঘটনার রাশ টেনে ধরতে সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানাতে হবে।
পাশাপাশি অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের কথা বলেন জিনাত আরা হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পথেঘাটে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রতিটি ঘটনায় অবশ্যই বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর পোশাক-আচরণ নিয়ে দোষারোপের সংস্কৃতিও বন্ধ করা দরকার।’