ময়মনসিংহের শশী লজে একদিন

‘রাজবাড়ির হলঘরে বাদ্য-বাজনা হইত। নর্তকীরা নাচত। বাড়ির মধ্যে ফোয়ারা, এত যুগ আগে এইটা যে কেমনে চালাইত কে জানে!’ কথাগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাস্টাররোলের শ্রমিক আমির হোসেনের। সাত মাস ধরে তিনি ময়মনসিংহের রাজবাড়ি নামে পরিচিত ‘শশী লজ’ ভবনটি দেখাশোনা করছেন।
গত বছরের মে মাসে ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেওয়া হয়েছে। চলছে ভবনটিকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনার কাজ। তবে কাজের গতি খুব ধীর। বর্তমানে অনেকটা অরক্ষিত আছে ভবনটি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে শশী লজ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন এবং বাংলা উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে নয় একর জায়গায় একটি দ্বিতল ভবন তৈরি করেন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত। তাঁর দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে ভবনের নাম রাখা হয় শশী লজ। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়। ১৯০৫ সালে একই জায়গায় পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আবার ভবন তৈরি করেন। ভবনের মূল ফটকে আছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরের প্রায়

৩৬টি ঘরের প্রতিটিতেই ছাদ থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। ভবনের ভেতরে আছে মার্বেল পাথরের ফোয়ারা। দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গমগাছ ছিল, যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনের পেছন দিকে রয়েছে গোসলের জন্য দোতলা গোসলখানা। ধারণা করা হয়, এখানে বসেই রানি পাশের পুকুরে ভেসে বেড়ানো হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুর ঘাটটি ছিল মার্বেল পাথরের। ভবনের সামনে বাগানের মাঝখানে আরেকটি শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরত মর্মর মূর্তি। ছিল পদ্ম বাগান।
গত ২৭ জুলাই সকাল ১০টায় ভবনের মূল ফটক পার হতে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো না। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়োগ করা আনসার বাহিনীর সদস্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভবনের বিভিন্ন জিনিস দেখার সুযোগ মেলে। জীর্ণ দশার ভবনটি দেখলেই আন্দাজ করা যায়, একসময় জৌলুশ ছিল বেশ।
ভবনের সামনের বাগানসহ বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। কয়েকজন দর্শনার্থীও এসেছেন বাড়িটি দেখতে।
ফোয়ারার ভেনাসের মূর্তি ফেলে ভবনের দিকে এগোলে কয়েকটি খোলা জানালা চোখে পড়ে। বাতাসে নড়ছে। তা দেখে মনে হবে ভেতরে এখনো জমিদারের বসবাস। তবে ভবনে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই, তালা দেওয়া। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে শ্রমিক আমির হোসেনের সঙ্গে ভেতরে ঢোকার সুযোগ মেলে। বেশ কয়েকটি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে শিয়ালের বিষ্ঠা। জানা গেল, চারজন শ্রমিক পুরো বাড়ি দেখাশোনার কাজ করছেন। তাঁদের কাজ বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। তবে আমির হোসেনের মতে, মাত্র চারজন দিয়ে এত বড় বাড়ি দেখে রাখা কঠিন। ৩৬টি ঘরের মধ্যে ৪টি ঘরে কাজ চলছে। কারুকাজ করা বাড়ির দরজা-জানালাগুলোর বেশির ভাগই ভেঙে গেছে। ভাঙা ঝাড়বাতির আর কোনো জৌলুশ নেই। হলঘরের কাঠের পাটাতন বানানোর জন্য আবার কাঠ এনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ভবনের ছাদ থেকে পানি পড়ে। জমিদার আমলের দু-একটি সিন্দুক এখনো সেখানে পড়ে আছে। ১৯৫২ সাল থেকে এ ভবনের বিভিন্ন কক্ষে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রয়োজনে টয়লেট বানিয়েছিল।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী জিম্মাদার সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটির সংস্কারকাজ চলছে। সীমানাপ্রাচীর আগের আদলে ফিরিয়ে আনতে হবে, তা অনেক ব্যয়বহুল। ২৭ জুলাই সকালের দিকে সৈয়দা শেফালি আক্তার নার্সারিতে পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন। বিয়ের পর ২০ বছর ধরে শেফালি আক্তার ময়মনসিংহ শহরে আছেন। তিনি নিজেও ঘুরতে এসে এ বাড়ির দোতলা স্নানঘরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেন। কিন্তু এখন আর সে সিঁড়ি ব্যবহার করার উপযোগী নেই। তাই খানিকটা মন খারাপ তাঁর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন মিয়া এসেছেন তাঁর বন্ধুকে নিয়ে। চট্টগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন নাজমুল ইসলাম। অবাধে রাজবাড়ির ভেতরে সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি। ভবনটির দ্রুত সংস্কারেরও দাবি তাঁর।
দর্শনার্থীদের অবাধে বিচরণ সম্পর্কে মূল ফটকে দায়িত্ব পালন করা আনসার সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখানে টিকিট পদ্ধতি চালু হয়নি। দর্শনার্থীদের নাম-পরিচয় লিখে রাখারও কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সন্দেহভাজন মনে হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়।