মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' বলেন গোলাম আযম

গোলাম আযম
গোলাম আযম

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এ দেশে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন জঘন্য অপরাধে পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকে ‘গোলযোগ’ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলেছেন তিনি। গোটাসময় তিনি জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রসংঘসহ বিভিন্ন স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠনগুলোকে সুসংগঠিত করেছেন। একাত্তরে তাঁর কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা ও বিবৃতি ছাপা হয়েছে তত্কালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। 

পাঠকদের জন্য বাছাই করা এরই কিছু অংশ: 
৮ এপ্রিল ১৯৭১ সালে জামাতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মওলানা নুরুজ্জামান ও জামাতের অপর নেতা গোলাম সারওয়ারের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে গোলাম আজম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ এজেন্ট ও পাকিস্তান বিরোধী’ বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।’ 
৯ এপ্রিল ১৯৭১ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে দেওয়া বেতার ভাষণে গোলাম আজম সবাইকে ‘স্বীয় প্রচেষ্টায় নিজেদের ভাগ্য প্রণয়নের আহ্বান’ জানান। ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ শীর্ষক বইয়ে বলা হয়েছে, ‘ভাগ্য প্রণয়ন’ বলতে তিনি বাঙালিদের সম্পত্তি লুট করাকে বুঝিয়েছেন। এর কয়েকদিন পর শান্তি কমিটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ইতিপূর্বেকার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রত্যেক দিন সকাল আটটা থেকে ১২টা এবং বিকাল তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত অফিস চলাকালীন সময়ে অফিস থেকে দোকান ও গৃহ বরাদ্দের জন্য ফরম বিলি ও দরখাস্ত গ্রহণ চলবে।’
১৮ জুন লাহোর বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গোলাম আজম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার আরও উন্নতির জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছেন। ঠিক কী পরামর্শ ভেঙে না বললেও তিনি বলেন, ‘দুষ্কৃতকারীরা এখনও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। ত্রাস সৃষ্টি এবং বিশৃংখলা অব্যাহত রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। দুষ্কৃতকারীরা নকশালপন্থী ও বামপন্থী শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। জনগণ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা দানে ইচ্ছুক, কিন্তু জীবন নাশের জন্য দুষ্কৃতকারী হুমকি দেয়ায় তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ সাহায্য দান করতে পারছে না।’ 
১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আজাদী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি আয়োজিত কার্জন হলের সভায় গোলাম আজম ‘পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায় তন্নতন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিকদের শান্তি কমিটির সাথে সহায়তা করার উদাত্ত আহ্বান’ জানান। সবশেষে তিনি ‘শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ ক্রমেই সরকারকে দেশের সংহতির খাতিরে পদক্ষপ গ্রহণ করা উচিত’ বলে বক্তৃতা শেষ করেন। 
২৩ আগস্ট লাহোরে জামাতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় গোলাম আজম বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে যারা অদেশপ্রেমিক দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তারা হয় এ সত্য জানেন না বা স্বীকার করার মত সত্ সাহস নেই যে, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষদাঁত ও নখ’ ভেঙে দেওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের বহু সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন।’ 
২৬ আগস্ট পেশোয়ারের সাংবাদিক সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের মীরজাফরী ও ভারতের দুরভিসন্ধি হতে সশস্ত্র বাহিনী দেশকে রক্ষা করেছে।’ 
এ সফরের সময় লাহোরের সাপ্তাহিক জিন্দেগীকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা ছিল এদেশের মাটিকে রক্ষা করার জন্য। এর আগেই অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল না কি’?
১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেইনিং কলেজে আলবদর হেড কোয়ার্টারে এবং রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন গোলাম আযম। রাজাকার ও আলবদরদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা অভ্যন্তরীণ দুশমনদের দমন করার কাজে যত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে পারবে, ততই তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজে ফিরে যেতে পারবে।’
১৬ অক্টোবর বায়তুল মোকাররমে জামাতে ইসলামীর জনসভায় গোলাম আযম বলেন, ‘জামাতে ইসলামী গোটা দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিরলসভাবে শান্তি কমিটির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।’ 
২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে এক সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, ‘আক্রমণই সর্বোত্তম পন্থা।’ ৩ ডিসেম্বর করাচিতে পৌঁছে তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র দপ্তরের ভার কোনো পূর্ব পাকিস্তানিকে দিতে হবে। কারণ এ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পূর্বপাকিস্তানিই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ তামাশা’ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন।’ 
মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকার কাছে এসে পৌঁছান, তখন গোলাম আযম জামাতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক কমিটির বৈঠকে যোগদানের নামে জামায়াতের সহকারী প্রধান মওলানা আব্দুর রহিম এবং প্রাদেশিক রাজস্ব মন্ত্রী একেএম ইউসুফকে নিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পাকিস্তানে যাওয়ার পর সেখান থেকে গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তত্পরতা চালিয়ে যেতে থাকেন। 
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানে বসে উর্দু ডাইজেস্টের এডিটর আলতাফ হোসাইন কুরাইশীকে গোলাম আযম বলেন, ‘উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম হিন্দু ও শিখ বাহিনীর নিকট প্রায় এক লাখ সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। হাজার বছরের ইতিহাসে এতো বড় ঘটনা কখনো ঘটেনি। ইংরেজ আমলেও (১৮৩১) মুজাহিদ বাহিনী শিখদের নিকট আত্মসমর্পণ করেনি।’ 

১৬ ডিসেম্বরের পর জামাতের অন্যান্য যেসব নেতা ও কর্মী বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগ মিলিত হন লন্ডনে। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনোটে নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য ইচ্ছুক ব্যক্তিদের আবেদন জানাতে বলা হয়। 
সঙ্গে সঙ্গে গোলাম আযম লন্ডন থেকে নাগরিকত্ব ফিরে পাবার দরখাস্ত করেন। ১৯৭৭ ও ৭৮ সালে তিনি আবার দরখাস্ত করেন। ২০ মার্চ ১৯৭৮ সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব দানে অস্বীকার করে। ১১ জুলাই ১৯৭৮ তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। অসুস্থ মাকে দেখার জন্য মানবিক কারণে তাঁকে তিন মাসের ভিসা দেওয়া হয়। এরপর তিনি আর ফেরত যাননি।