পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমান একাই খুন করেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন পুলিশের কর্মকর্তারা। এদিকে গতকাল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও ঐশী নিজেই তার বাবা-মাকে খুনের কথা স্বীকার করেছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।জবানবন্দি দেওয়ার পর ঐশী ও গৃহকর্মী খাদিজা ওরফে সুমিকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান ওরফে রনিকে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ঐশী একাই তার বাবা-মাকে খুন করার কথা বলেছে। বাবা-মা নাকি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে বাধ্য করেছে। এগুলো তার পছন্দ হয়নি। এরপর সে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ঘটনার সাত-আট দিন আগে সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাবা-মাকে খুন করে সে স্বাধীন হবে।মনিরুল বলেন, সাধারণত একটি হত্যাকাণ্ডে অনেকেই বিভিন্নভাবে জড়িত থাকে। এ হত্যাকাণ্ডে ঐশী ছাড়া আর কেউ জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঐশীর এক বন্ধুকেও খোঁজা হচ্ছে।১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর চামেলীবাগের বাসা থেকে মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে মেয়ে ঐশী ও গৃহকর্মী সুমি নিখোঁজ ছিল। ১৭ আগস্ট ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে। তার তথ্যের ভিত্তিতে সুমি ও মিজানুর রহমান ওরফে রনিকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় মাহফুজের ভাই মশিহুর রহমান পল্টন থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ১৮ আগস্ট ঐশী, সুমি ও রনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে গতকাল তাদের আদালতে পাঠানো হয়।
জবানবন্দি: আদালত সূত্র জানায়, গতকাল ঢাকা মহানগর মুখ্য আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার ছাদাতের খাসকামরায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ঐশী। আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে ঐশী জানায়, ঘটনার আগের দিন জনি নামের এক বন্ধুর কাছে সে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানায়। হত্যার পর তাকে আশ্রয় দেওয়ার আশ্বাস দেয় জনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঐশী ছয় পাতার ৬০টি ঘুমের ট্যাবলেট কেনে। ৩০টি করে ট্যাবলেট সে মা-বাবার কফিতে মেশায়। মা-বাবা কফি খাওয়ার পর অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর সে প্রথমে বাবাকে ছুরিকাঘাত করে। বাবা গোঙাতে থাকলে ওড়না দিয়ে সে বাবার রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। বাবার গোঙানির শব্দে মা জেগে ওঠেন। মা পানি চান। মাকে পানিও দেয় সে। পানি খাওয়া শেষ হলে মায়ের শরীরে বেশ কয়েকবার ছুরিকাঘাত করে সে। শেষমেশ মায়ের শ্বাসনালিতে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর ঐশী ও গৃহকর্মী মিলে দুজনের লাশ বাথরুমে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। রক্ত পরিষ্কার করে সকালে তারা বেরিয়ে যায়।
মাদকাসক্ত ছিল কি না পরীক্ষা হয়নি: ঐশীর মাদকাসক্তির ব্যাপারে কোনো পরীক্ষা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে পুলিশের কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় সে মাদকাসক্ত ছিল কি না, তা পরীক্ষা করার সুযোগ ছিল না। কারণ, ১৪ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর ১৭ আগস্ট সে পল্টন থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে।
তাহলে কিসের ভিত্তিতে আপনারা ঐশীকে মাদকাসক্ত বলছেন? জবাবে মনিরুল বলেন, ঐশীর মাদক সংগ্রহের কিছু তথ্য ও আলামত পুলিশের হাতে আছে। খুনের পর ঐশী বাড়ি থেকে চলে গেল কেন? মনিরুল বলেন, সে তার ভাইকে নিয়ে আরেকটি ভাড়া বাসায় থাকার কথা ভেবেছিল। তাই সে কিছু টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
৩০টি চেতনানাশক ওষুধ মেশালে কফির স্বাদ তো নষ্ট হওয়ার কথা, সেই কফি কীভাবে মানুষ খেতে পারে? মনিরুল বলেন, ‘কফি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।’ রাত ১১টায় বাসায় ফিরে কেউ কি কফি খেতে চায়? তাঁর জবাব, অনেক মানুষ রাতে ঘুমানোর আগেও কফি খায়।
বয়স বিতর্ক এবং পুলিশের বক্তব্য: বয়স বিবেচনায় ঐশী ও সুমিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর মাহফুজুর রহমানের ভাই মশিহুর রহমান যে মামলা করেছেন, তাতে তিনি ঐশীর বয়স লিখেছেন ১৭। তবে ঐশী ডিবিকে জানিয়েছে ১৮। যে ক্লিনিকে ঐশী জন্মেছে, সেখান থেকেও পুলিশ তথ্য নিয়ে তার বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার বয়স নির্ধারণের জন্য পরীক্ষাও করা হয়েছে। এখনো প্রতিবেদন হাতে আসেনি। বয়স-সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত পেলে তা আদালতে দেওয়া হবে। আর শিশু আইন অনুযায়ীই সুমিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে দাবি করেন মনিরুল।