এবারের ঈদযাত্রা
ভোগান্তি নিয়েই যেতে হবে বাড়ি
যাত্রীদের বড় অংশ যানবাহনের সংকটে পড়বে। এর সঙ্গে যোগ হবে পথের ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় দুই বছর পর এবার ঈদুল ফিতর হতে যাচ্ছে মুক্ত পরিবেশে। যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ না থাকায় গত ঈদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ মানুষ এ বছর ঢাকা ছাড়তে পারেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের আগের চার দিনে ঢাকা ছাড়তে পারেন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। ওই চার দিনের প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে যেতে পারেন। যাত্রীদের বড় অংশ যানবাহনের সংকটে পড়বে। এর সঙ্গে যোগ হবে পথের ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলে করে ঈদের সময়ে প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ লাখ মানুষের ঢাকা ছাড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ১২ থেকে ১৩ লাখ মানুষকে ঢাকা ছাড়তে হবে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেনের ছাদ ও লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।
‘ঈদযাত্রায় অসহনীয় যানজট, পথে পথে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের দাবি’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। গতকাল রোববার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এআরআইয়ের চলমান এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ঈদের সময় দিনে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারেন। এর মধ্যে বাসে ৮ লাখ, ট্রেনে ১ লাখ, লঞ্চে দেড় লাখ, ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রায় ৪ লাখ এবং মোটরসাইকেলে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারবেন। বাকি ১২-১৩ লাখ মানুষ কীভাবে ঢাকা ছাড়বেন, সেই ব্যবস্থা এখনো নেই। তাঁদের ঢাকা ছাড়তে হবে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেনের ছাদ ও লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে।
তবে পরিবহন মালিকদের অনেকে বলছেন, এবার ঈদের ছুটি তুলনামূলক দীর্ঘ। বাসে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকবে ২৮ ও ৩০ এপ্রিল। এই দুদিনের টিকিটের চাহিদা বেশি।
ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি
এআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ঈদে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি দুর্ঘটনা হয়েছে। এবার দ্বিগুণ মানুষের গ্রামে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এবং সড়ক ও যানবাহনের সেই সক্ষমতা না থাকায় দুর্ঘটনা আরও বেশি হতে পারে। আবার যাত্রীদের চাপে সড়কের ব্যবস্থাপনা ‘কোমায়’ চলে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
সড়কে গাড়ি ও যাত্রীর চাপ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি হয়ে গেলে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা কাজে লাগবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ২০ রমজানের পর বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবারের সদস্যদের যাঁদের কাজ নেই, তাঁদের ২০ রমজান থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ তাঁর। তিনি বলেন, যাঁরা কর্মজীবী, ছুটি পেলে তাঁরা পরে যাবেন। তাহলে ঈদযাত্রায় যে যানবাহনের সংকট ও ভোগান্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এই রমজানে রাজধানীবাসী যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন বলে উল্লেখ করেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, রাজধানীর সব ফুটপাত ও রাস্তা অবৈধ পার্কিং এবং হকারমুক্ত করা প্রয়োজন। রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মোড় পরিষ্কার রাখা ও ছোট যানবাহন বিশেষ করে রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক প্রধান সড়কে চলাচল বন্ধের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে আগামী ২৫ রমজান থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী যানজটে অচল হয়ে পড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি তাওহিদুল হক, যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হক প্রমুখ।
প্রস্তুত নয় মহাসড়ক
ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর গত শনিবার এক বৈঠকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে সব মহাসড়ক চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দেয়। ওই বৈঠকে বলা হয়, যেখানে যেখানে মেরামত দরকার, তা আগে করে ফেলতে হবে। অবশ্য এর আগে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে রাস্তা মেরামতের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
কয়েক বছর ধরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে আশুলিয়ার নবীনগর মোড় পার হতেই যানজটে ভুগতে হয়। আবার এই মহাসড়কের টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত দুই লেনের সড়ক। সেতুও দুই লেনের। যানবাহনগুলো দুই লেনের মুখে আটকে যায়। সেখান থেকেই যানজটের শুরু। বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল দিতে গিয়েও ঈদের সময় দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম দিকে মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ফলে মহাসড়কটির কোথাও সংকুচিত, আবার কোথাও একমুখী। ঈদের সময় অতিরিক্ত গাড়ির চাপে এই মহাসড়কে যানজটে পড়তে হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ঢাকা থেকে রংপুর যেতে এখনই ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে যায়। ঈদের সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
ঈদের সময় যানজটে ভোগান্তি হতে পারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও। এই মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি অংশের বারপাড়া এলাকায় চার লেনের সংস্কারকাজের কারণে দু-তিন কিলোমিটার এলাকায় এখন প্রায় নিয়মিতই যানজট হচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়মিতই যানজটে আটকা পড়ে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। এই মহাসড়কের টঙ্গী থেকেই মূলত দুর্ভোগের শুরু। মহাসড়কের এই অংশ খানাখন্দে ভরা। বেহাল সড়কের একদিকে চলছে উন্নয়নকাজ, অন্যদিকে সংকুচিত। এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কয়েক লাখ যানবাহন চলে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর থেকে ভুলতা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। এর কারণ, মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে যানবাহনের স্ট্যান্ড ও অবৈধ পার্কিং। কাঁচপুর সেতুর নিচে শ্যামবাজার বাসস্ট্যান্ড ও তারাব চৌরাস্তায় মহাসড়ক দখল করে গড়ে তোলা লেগুনাস্ট্যান্ডে যাত্রী ওঠানো–নামানোর কারণেও যানজট হচ্ছে। এ ছাড়া এই মহাসড়কের যাত্রামুড়া বাজার ও বরাব থেকে ভুলতা পর্যন্ত দুই পাশ দখল করে বাস ও ট্রাক পার্ক করে রাখা হয়।
মহাসড়কে যানজটের বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, দেশের মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে, এটা ভেবে অনেকে আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। তাঁদের যানবাহনের সংখ্যা কত আছে, সেটাও দেখতে হবে। ১২-১৩ লাখের ঘাটতি পূরণ হবে না। ঘাটতি পূরণের জন্য গণপরিবহন বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু তখন সড়ক সেই চাপ নিতে পারবে না।
আরও যত শঙ্কা
পদ্মা নদীর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে যাত্রীবাহী বাস ও পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাকের জন্য ফেরি পাওয়া দুষ্কর। যেদিন ঘাটে চাপ বেশি থাকে, সেদিন ফেরি পেতে লাগে ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা। আর যেদিন চাপ কম থাকে, সেদিন লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। যেসব ট্রাক অপচনশীল পণ্য পরিবহন করে, সেসব ট্রাককে দুই থেকে তিন দিনও ফেরিঘাটে বসে থাকতে হয়।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ বিভিন্ন ফেরিঘাটে যানবাহন চলাচল প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও ফেরির সংখ্যা কমেছে। ফলে এই ঈদে এখানে শত শত যানবাহন উভয় পাড়ে আটকা পড়তে পারে। এসব ফেরিঘাটে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো, বিদ্যমান ফেরিগুলো যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এ ছাড়া এবারের ঈদে কালবৈশাখীর শঙ্কা থাকায় নৌপথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ত্রুটিপূর্ণ নৌযান বন্ধসহ ফিটনেসধারী নৌযান যাতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করতে না পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা।
ঈদযাত্রায় চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি এফবিসিসিআইয়ের
ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন সড়কে চলমান সংস্কার ও নির্মাণকাজ ঈদের আগে-পরে মোট ১৪ দিন বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। গতকাল সংগঠনটির পরিবহন ও যোগাযোগ (রেল, সড়ক ও মহাসড়ক) বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক হয়। এই বৈঠকে বলা হয়, বিভিন্ন সড়কে সংস্কার ও নির্মাণকাজ চলায় যানবাহনের গতি কমে দীর্ঘ যানজট তৈরি করছে। ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি কমাতে ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সব ধরনের সংস্কার ও নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার পাশাপাশি মহাসড়কের যেসব অংশে বেশি যানজট হয়, সেসব স্থানে সার্বক্ষণিক হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে এফবিসিসিআই।
সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারি সংস্থাগুলোর কঠোর পদক্ষেপ নিতে বৈঠক থেকে দাবি জানান এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) শিগগিরই চিঠি দেবে এফবিসিসিআই।