ভিন্ন পথে ইতালি যেতে মরিয়া বাংলাদেশিরা

■ ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে বসনিয়া গেছেন ২ হাজার ৫৫৩ জন বাংলাদেশি।

■ ২০১৮ সালে গিয়েছিলেন মাত্র ৪১৮ বাংলাদেশি।

প্রতি বছরই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন এশিয়া–আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশী
ফাইল ছবি

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে ইতালিতে ঢুকতেন লোকজন। এখনো সে পথে যান অনেকে। কিন্তু সে পথে নজরদারি বাড়ায় পাচারকারীরা নতুন রুট বলকানের দেশ বসনিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়াকে বেছে নিয়েছে। মূলত ক্রোয়েশিয়া থেকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে লোকজনকে ইতালি পাঠাচ্ছে চক্রটি। নতুন এই পথে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা গত তিন বছরে পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে।

সপ্তাহ দুয়েক আগে ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের কাছের বনে ও পরিত্যক্ত ভবনে ৩০০ বাংলাদেশির আটকে পড়ার প্রথম খবরটি আসে। এরপর থেকে নানা সূত্রে জানা গেছে, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়াসহ বলকানের দেশগুলো দিয়ে ক্রোয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের লোকজনের ইতালি যাওয়া ২০১৮ থেকেই বেড়ে চলেছে।

গত কয়েক দিনে জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বসনিয়ায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৬৫ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী নাম নিবন্ধন করেছেন। নিবন্ধনকারী লোকজনের শেষ গন্তব্য ইতালি। এর মধ্যে শুধু এ বছরের প্রথম ৯ মাসে নিবন্ধন করেছেন ১৩ হাজার ৪৭০ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ মাসে ২ হাজার ৫৫৩ জন বাংলাদেশি বসনিয়া পৌঁছেছেন। অথচ ২০১৮ সালে মাত্র ৪১৮ বাংলাদেশি বসনিয়ায় পৌঁছান।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তারা জানান, বৈধ-অবৈধ যা–ই হোক, বসনিয়ায় এসে অভিবাসীদের নাম নিবন্ধন করতে হয়।

গত বৃহস্পতিবার আইওএমের বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দপ্তরের প্রধান পিটার ভন ডার অরায়ের্ট প্রথম আলোকে বলেন, ইতালি পাঠাতে লোকজনকে বসনিয়া পর্যন্ত নেয় মানব পাচারকারী চক্র। সেখান থেকে ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত। তারপর অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি। বাংলাদেশিদের বসনিয়া পৌঁছানোর সংখ্যা গত তিন বছরে পাঁচ গুণের বেশি বেড়েছে।

২০১৮ সাল থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য বসনিয়ায় পৌঁছেছেন ৬৫ হাজার অভিবাসী। তাঁদের ১৯ শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিক

বসনিয়ার আইওএম দপ্তর এই প্রতিবেদকের পাঠানো ই-মেইলে গত তিন বছরে বিশ্বের কোন দেশের কত অভিবাসনপ্রত্যাশী জাতিসংঘের সংস্থাটির কাছে নাম নিবন্ধন করেছেন, তার একটি পরিসংখ্যান পাঠিয়েছে। ওই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তিন বছর ধরে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বসনিয়ায় পৌঁছানো লোকজনের মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া ও মরক্কো—এই দেশগুলো শীর্ষে রয়েছে। চলতি বছর শীর্ষ তালিকায় আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পরেই আছে বাংলাদেশের নাম।

আরও পড়ুন

বসনিয়ার জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির আটকে পড়ার খবর গত মাসের শেষ দিকে রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলো প্রথম প্রচার করে। ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের কাছের বনে ও পরিত্যক্ত ভবনে আটকে পড়া অন্তত ৫০০ অভিবাসনপ্রত্যাশীর ৩০০ জন বাংলাদেশের বলে জানা যায়। মূলত এ খবরটির মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে ভূমধ্যসাগরের পর মানব পাচারকারীদের এখন বড় রুট হয়ে উঠেছে বলকানের দেশ বসনিয়া, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া আর ক্রোয়েশিয়া। আইওএমের বসনিয়া দপ্তরের প্রধান পিটার ভন ডার অরায়ের্ট ২ অক্টোবর ভেলিকা ক্লাদুসা পৌঁছে অপেক্ষমাণ অভিবাসীদের বেশির ভাগই যে বাংলাদেশি, সেটি নিশ্চিত করেন। সেখানে অবস্থানের সময় তিনি বাংলাদেশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।

পিটার ভন ডার অরায়ের্ট গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে কজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁদের প্রত্যেকে ৫ থেকে ১০ হাজার ইউরো (১০০ দশমিক ২৩ টাকায় এক ইউরো) কিংবা ৭ থেকে ১২ হাজার ডলারের (৮৪ দশমিক ৭৫ টাকায় এক ডলার) বিনিময়ে ইতালি যাওয়ার জন্য বসনিয়ায় পৌঁছেছেন।’ তিনি জানান, ইতালি যেতে আগ্রহী বাংলাদেশের লোকজন দেশ থেকে কোন কোন রুট ধরে যাত্রার শুরুটা করেন, সেটি তাঁর কাছে পরিষ্কার করেনি। তবে এঁদের অধিকাংশই তুরস্ক পৌঁছানোর পর বলকানের দেশগুলোর উদ্দেশে যাত্রা করেন। তুরস্ক থেকে এঁরা যাত্রা করেন গ্রিসে। এরপর বেছে নেন দুটি রুট। একটি রুট হচ্ছে গ্রিস-আলবেনিয়া-মন্টেনেগ্রো-বসনিয়া। অন্য রুটটি হচ্ছে গ্রিস-উত্তর মেসিডোনিয়াা-সার্বিয়া-বসনিয়া। বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তি বসনিয়ায় পৌঁছেছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশই উত্তর মেসিডোনিয়া আর বাকি ২০ শতাংশ বেছে নেন আলবেনিয়ার রুটটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতিসংঘের একটি দায়িত্বশীল সূত্র গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন বছরে বসনিয়ায় বাংলাদেশের লোকজনের উপস্থিতি থেকে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করে যাচ্ছে। তা না হলে এত দ্রুত সংখ্যাটা ৪০০ থেকে তিন বছরের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ হওয়ার কথা নয়।