ভারতে পাচার হওয়া প্রায় ২ হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে পাচারের শিকার হওয়া নারী ও শিশুর প্রকৃত সংখ্যা কত, দেশটিতে কতজন নারী এখনো চক্রের হাতে আটকে রয়েছেন, সে তথ্য কেউ জানাতে পারেনি।
ভারতে পাচার হওয়া নারীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করা দুই বেসরকারি সংস্থা জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর জানিয়েছে, দেশটির পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর সেখানকার সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি নারী রয়েছেন। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের সহায়তায় তাঁদের ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী পাচারের ২৫০টি ঘটনা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভুক্তভোগী নারীদের ৯০ শতাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। আর ৯৫ শতাংশকে ভারতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তাঁদের মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই নারীদের বেশির ভাগকে জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়।
বিশ্লেষণে আসা ২৫০টি ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ১৫৪ জনের বয়স জানা গেছে। এর মধ্যে ৭১টি কিশোরী, ৪৭ জনের বয়স ১৯ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, ৩১ জনের বয়স ২৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বাকি ৪ জনের বয়স এর চেয়ে বেশি।
নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গত মাসের শেষ দিকে ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। এ ঘটনায় ভারতের পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে রয়েছেন ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়। এদিকে ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশ ও র্যাব দাবি করেছে।
বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ পাচারের শিকার, কত মামলা—এসব তথ্য এখন আর পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় না। তবে একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির কাছ থেকে। তারা পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়ে জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় দেশে ও দেশের বাইরে ৬ হাজার ৭৩৫টি মামলা হয়েছে।
যাঁরা ভারতে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি চক্র র্যাব-পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ব্র্যাক আরও জানায়, মামলাগুলোতে ভুক্তভোগীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১২ হাজার ৩২৪। সংখ্যাটি নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে। এ সময়ে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্ধার করা ও দেশে ফেরত আনা হয়েছে ৯ হাজার ৭১০ জনকে। ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বেশি মানব পাচারের ঘটনা ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ভারতে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি চক্র র্যাব-পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, ভারতে যাঁরা এখনো আটক রয়েছেন, তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ভুক্তভোগী বেশি দক্ষিণ-পশ্চিমে
ভারত থেকে যে ২ হাজার নারীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৬০০ জনকে ফিরতে সহায়তা করেছে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। আর রাইটস যশোর সহায়তা করেছে ৪০০ জনকে। বিগত কয়েক বছরে ফিরিয়ে আনা নারীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। যেমন ২০২০ সালে দুই সংস্থার সহায়তায় ফেরত আসতে পেরেছেন ৬৯ জন। আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ১৭৬। করোনাকালে এই কার্যক্রম গতি হারিয়েছে বলে জানালেন এ কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও যশোর রাইটস জানায়, পাচার হওয়া নারীদের বেশির ভাগ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর। রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের কাজ দেওয়ার কথা বলে ভারতে নেওয়া হয়। ভুক্তভোগী নারীদের প্রায় সবাই অল্প শিক্ষিত।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যে ২৫০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যকের বাড়ি যশোর (৩৬), নড়াইল (২৫), সাতক্ষীরা (২৩) ও খুলনায় (২৬)।
তথ্য সংগ্রহের জন্য ৮ জুন জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে গেলে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা দীপ্তি রানী বল ভারতের একটি সেফহোমে থাকা ১৭ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি কিশোরীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দেন। এই কিশোরীর বাড়ি খুলনায়। ছোটবেলায় তার মা মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করেন। সংসারে তাকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
কিশোরীটি জানায়, তিন বছর আগে তার গ্রামের নাসির নামের এক লোক তাকে যশোরে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে আসেন। তবে নাসির তাকে বেনাপোল দিয়ে ভারতে পাচার করেন। ভারতের মুম্বাইয়ে একটি হোটেলে আটকে তাকে যৌনকর্মীর কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এক বছর আগে মুম্বাই পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ভারতে পাচার হওয়ার পর পুলিশ যাঁদের উদ্ধার করে, তাঁদের সেফহোমে এক থেকে দুই বছর থাকতে হয়। এ সময়ে আইনি প্রক্রিয়া চলে। ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হওয়া দরকার।
* ৯৫ শতাংশকে ভারতে নেওয়া হয় কাজ দেওয়ার কথা বলে। * মানব পাচারের মামলা ৪,৯৪৫টি। আসামি ২৪,৯১৪ জন। গ্রেপ্তার ৪৪%। * ২০২০ সালে ১৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ১টিতে।
পাচার হয় ১৮ জেলা দিয়ে
ভুক্তভোগী, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও মানব পাচার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের ১৮টি জেলা দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করা হয়। তবে ভারতে পাচার করা বেশির ভাগ নারীকে দেশটিতে নেওয়া হয় যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্ত দিয়ে। এ দুই জেলায় রুট ২২টি। এর মধ্যে যশোরের শার্শা, ঝিকরগাছা ও চৌগাছার ১৯টি সীমান্ত পথ রয়েছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের যে জাতীয় মনিটরিং সেল আছে, তার নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। সীমান্ত বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারিও জরুরি।
২০২০ সালে সাজা ১টি মামলায়
অভিযোগ আছে, মানব পাচারের মামলা নিষ্পত্তির হার কম। আবার আসামিদের সাজার হারও কম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের গত জানুয়ারি মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে মানব পাচারসংক্রান্ত ৪ হাজার ৯৪৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৫৫৪টি মামলার তদন্ত চলছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত শেষে আদালতে বিচার চলছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ২৪ হাজার ৯১৪। আর মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ১০ হাজার ৯৫১ জন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৫৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। সাজা হওয়া মামলায় আসামিদের ১৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০২০ সালে ১৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে সাজা হয়েছে একটিতে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাদীপক্ষ মামলা করে অনেক সময় আপস করে আর সাক্ষী দিতে আদালতে হাজির হয় না। আদালতে হাজির হলেও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। সাজা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে হাজির করা দরকার। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ যাতে আরও সচেষ্ট হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
‘নজরদারির অভাব’
মানব পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলে এভাবে বছরের পর বছর শত শত নারীকে ভারতে পাচার করা সম্ভব হতো না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর যাতে কোনো নারী পাচারের শিকার না হন এবং ভুক্তভোগীরা যাতে দেশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।