বাংলাদেশেও অমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ
সপ্তাহ তিনেক আগে বাংলাদেশে করোনার নতুন ধরন অমিক্রনের সংক্রমণ ছিল সীমিত পরিসরে, সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। সংক্রমণের এমন পর্যায় গুচ্ছ সংক্রমণ (ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন) নামে পরিচিত। এখন ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও অমিক্রন শনাক্ত হচ্ছে।
এরই মধ্যে সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে দৈনিক শনাক্ত ও পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার বাড়ছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে রোগী শনাক্ত তিন গুণ বেড়েছে। পরিস্থিতি দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার অমিক্রন ধরনের সামাজিক সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) হয়েছে। সারা দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না।
গত ২৪ ঘণ্টায় (গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে আজ শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ৪ হাজার ৩৭৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। প্রায় সাড়ে চার মাসের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ দৈনিক শনাক্ত ও শনাক্তের হারের রেকর্ড।
করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আজ এই প্রতিবেদক তিনজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা সরকার গঠিত করোনাসংশ্লিষ্ট তিনটি পৃথক কমিটির সদস্য। তাঁদের মতে, গত দুই সপ্তাহের সংক্রমণ পরিস্থিতি দেশে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহ সংক্রমণ মোকাবিলায় সতর্ক না হলে এই ঢেউয়ে সংক্রমণ অনেক বাড়বে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
করোনার নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালা কমিটির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক লিয়াকত আলী। এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী প্রথম আলোকে বলেন, পারিপার্শ্বিকতা ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, বর্তমান সংক্রমণ বৃদ্ধি অমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণের কারণেই। তবে এখনো সব জায়গায় এই সংক্রমণ ছড়াতে পারেনি। পরিস্থিতি বলছে, দেশে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
গত ৯ ডিসেম্বর জিম্বাবুয়েফেরত বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের দুই সদস্যের প্রথম অমিক্রনে আক্রান্তের খবর জানা যায়। এখন পর্যন্ত জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেশে ৩৩ জন করোনার অমিক্রন ধরনে সংক্রমিত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনার জিনোম সিকোয়েন্সের কাজটি এখন পর্যন্ত সুসংগঠিতভাবে করা হচ্ছে না। তাই করোনার কোন ধরন বেশি ছড়াচ্ছে, সে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আন্তর্জাতিক তথ্যভান্ডার জার্মানির দ্য গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে অমিক্রনে সংক্রমিত ৩৩ জনের মধ্যে রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা ৪ জন ও মহাখালীর ৬ জন। ২০ জন ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে আর কিছু জানা যায়নি। আর তিনজন যশোরের।
স্বাস্থ্য বিভাগ দেশে ৫০০ করোনা শনাক্ত রোগীর মধ্যে মাত্র ১ জনের নমুনার জিন বিশ্লেষণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত কমসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন ধরন কী পরিমাণে ছড়াচ্ছে, তা বলা মুশকিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র মো. রোবেদ আমিন গত বুধবার বলেছিলেন, অমিক্রনের পাশাপাশি ডেলটা ধরন—দুটিই বর্তমানে অবস্থান করছে। সংক্রমণ হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় ধরে নিতে হবে করোনার নতুন যে ধরন (অমিক্রন), তারই সংক্রমণ বেশি হচ্ছে।
করোনার ডেলটা ধরনের চেয়ে অমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর অসুস্থতা তুলনামূলক কম হলেও অমিক্রন বেশি সংক্রামক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, যাঁরা টিকা নেননি, তাঁদের জন্য অমিক্রন ধরন বিপজ্জনক। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, অমিক্রনে পুরুষের চেয়ে নারীর আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি। জিআইএসএআইডির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত অমিক্রনে সংক্রমিত ৩৩ জনের মধ্যে ২১ জনই নারী। বাকি ১২ জন পুরুষ।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ওই বছরের জুন-জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউ ছিল বেশ তীব্র। গত বছরের মার্চে শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। করোনার ডেলটা ধরনের সংক্রমণে গত বছরের মাঝামাঝি দেশে করোনায় মৃত্যু, রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার বেড়ে যায়। আগস্ট থেকে সংক্রমণ কমতে থাকে। তবে দুই সপ্তাহ ধরে আবার সংক্রমণে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সময়ে অমিক্রন ছাড়া করোনার অন্য কোনো ধরনের মাধ্যমে এত দ্রুত সংক্রমণ বৃদ্ধি সম্ভব নয়। দেশের করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তবে এর চূড়ায় পৌঁছাতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অমিক্রনের উপসর্গ ও তীব্রতা কম হওয়ায় অনেকে সংক্রমিত হলেও নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে উদাসীনতা রয়েছে আগের মতোই। স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি সংস্থাগুলো এখনো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেনি।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, তাঁদের অন্তত ২৫ শতাংশের জিনোম সিকোয়েন্স করা গেলে অমিক্রনের পরিস্থিতি বোঝা যেত। শনাক্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স হচ্ছে কম। যাদের কাজ সিকোয়েন্স করা, তারা তাদের কাজ করছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সবকিছুই করছে ঢিমেতালে। ফলে দ্রুত রোগী বাড়তে থাকবে।
শনাক্ত চার হাজার ছাড়াল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২৯ হাজার ৮৭৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৭৮ জন। এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল প্রায় সাড়ে চার মাস আগে, গত ২৬ আগস্টে।
এখন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৯ হাজার ৪২। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ১২৯ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৬ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫২ হাজার ৩০৬ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৩৫১ জন সুস্থ হয়েছেন।