পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল: ঢাবি শিক্ষক সমিতি

অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। ১৯ অক্টোবর, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো

নোয়াখালীতে স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ‘তৃতীয় পক্ষ’ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সুযোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সেখানে দীর্ঘ সময় তাণ্ডব চললে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সোমবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী ও কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মঙ্গলবার সকালে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধনে ওই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

‘সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াও, সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ো’ শীর্ষক মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান এবং শিক্ষক সমিতির নেতারা ছাড়াও আওয়ামী লীগপন্থী নীল দল ও বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য দেন। এ সময় শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সমিতির যুগ্ম সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আবদুর রহিম।

আবদুর রহিম বলেন, ‘পরিদর্শনকালে আমরা স্থানীয় সাধারণ মানুষ, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, আশপাশের ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করি। সবার বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৪৬ সালের পর নোয়াখালীতে বড় ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পূর্বাভাস ছিল। সেই অনুযায়ী প্রশাসনের অনুরোধে বিজয়া দশমীর দিনে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।’

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রতিমা বিসর্জন শেষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের ঘরে ফিরে যান। সেদিন জুমার নামাজ শেষে একশ্রেণির মুসল্লি নামাজ-পরবর্তী দোয়া-মোনাজাতে অংশ না নিয়েই বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করেন। কয়েকটি মসজিদ থেকে একযোগে এই মিছিল বের হয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ফুটেজ অনুযায়ী, খুবই তরুণ বয়সের মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীরা মিছিলে অংশ নিয়েছিল।

আবদুর রহিম বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এসব তাণ্ডবলীলা চললেও পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন। হামলার সময় মন্দির, আশ্রম ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও লুটপাট করা হয়েছে। মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রক্ষিত বিভিন্ন সামগ্রী, নথিপত্র, ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় ব্যক্তিদের ছবি-পোস্টার ধ্বংস করা হয়েছে।

শিক্ষক সমিতির পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘নোয়াখালীতে সহিংসতার ঘটনায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই অল্প বয়সের মাদ্রাসাশিক্ষার্থী। অনেকের বক্তব্য অনুযায়ী, কোমলমতি মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের এই ধারণা দেওয়া হয় যে প্রতিমা-মূর্তি ভাঙচুর ও সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের ওপর আক্রমণ চালালে তাদের বেহেশতের পথ সুগম হবে। তাদের মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয়নি, তারা একপক্ষীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। স্থানীয় রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের কারণে এই ঘটনায় তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়েছে বলে পরিদর্শনকারী দলের কাছে মনে হয়েছে।’

শিক্ষক সমিতি বলছে, সাম্প্রদায়িক এসব সহিংসতার বিষয়ে সরকার গভীরভাবে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা না নিলে দেশের অন্যান্য এলাকাও এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিতভাবেই এটি ঘটানো হয়েছে। পর্যবেক্ষণে স্থানীয় রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। সমিতি মনে করে, স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া প্রশাসনের পক্ষে এ ধরনের মব (উন্মত্ত জনতা) নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি গঠন করে মানুষের মধ্যে একটা জনমত তৈরি করা দরকার। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকারের এখনই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমন্বয় প্রয়োজন।

মানববন্ধনে যা বলা হলো
শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক নাশকতার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশ ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ এখানে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিপালনের পাশাপাশি উৎসবগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। এমন একটি মুহূর্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হলো, যখন সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্‌যাপিত হচ্ছিল বাংলাদেশের এই উৎসব সারা পৃথিবীতেই একটি উদাহরণ।

তৃণমূল পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতিবাদের গুরুত্ব আছে। কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সংশ্লিষ্ট স্থানে, যেখানে ঘটনা ঘটে। সেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষগুলোর ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত। আমাদের আহ্বান থাকবে, যেখানেই অপশক্তি মাথাচাড়া দেবে, সেখানেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষগুলো দল-মতনির্বিশেষে এসব অপপ্রয়াসকে সম্মিলিতভাবে নস্যাৎ করতে ভূমিকা রাখবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মীজানুর রহমান বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে যে লাঞ্ছনা ও আক্রমণের ঘটনা ঘটছে, তাতে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত ও বিক্ষুব্ধ। যারা এই তাণ্ডবের শিকার, কুমিল্লার একজন মানুষ হিসেবে আমি লজ্জিত। বাংলাদেশে এখন ধর্মের একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে। এদের বিশ্বাস খুবই ঠুনকো। অনুভূতিতে আঘাত লাগার নামে এরা দুর্বল ও সংখ্যালঘু মানুষের ওপর প্রতিহিংসামূলক বিভিন্ন ঘটনা ঘটায়।’

নীল দলের আহ্বায়ক ও বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন মো. আব্দুস ছামাদ বলেন, ‘অমানবিক, জঘন্য ও নৃশংস যে ঘটনাগুলো গত কয়েক দিনে ঘটেছে, সেগুলোর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সরকারের প্রশাসনিক নির্ভরতা দেখতে পাই। এই নির্ভরতা দেশের জনগণকে সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে না। আজ যদি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় থাকত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটানোর সাহস ওই মুষ্টিমেয় কিছু লোক পেত না।’

সাদা দলের আহ্বায়ক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি একটি ধর্মীয় ব্যাপার। সেখানে পবিত্র কোরআনকে ব্যবহার করা হয়েছে। কারা, কখন, কীভাবে পূজামণ্ডপে কোরআন রেখেছিল, তা আমাদের জাতির কাছে বড় প্রশ্ন। ওই ঘটনার ফলে আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল। কুমিল্লার ঘটনা কীভাবে ঘটল এবং কীভাবে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, তদন্তের মাধ্যমে তা বের করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ভবিষ্যতে আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। এ ধরনের ঘটনা রোধে প্রয়োজনে আমরা সারা দেশে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব।’

মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে যা কিছু ঘটছে, তা অশনিসংকেত। শর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। যা কিছু ঘটেছে, রাষ্ট্রের প্রশাসন, অন্তত নির্বাহী বিভাগ একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের ১৫টি জেলায় যেভাবে ঘটনার পর ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আমাদের সাংঘাতিকভাবে ভাবিয়ে তোলে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রশাসন থেকে তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, ধ্বংসস্তূপ এখনো সেভাবেই আছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন সাদেকা হালিম, শিক্ষক সমিতির সদস্য জিয়াউর রহমান ও চন্দ্রনাথ পোদ্দার, জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী, সাদা দলের নেতা মোহাম্মাদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর, টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক আ জ ম শফিউল আলম ভূঁইয়া, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস এবং ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষক সৌরভ সিকদার বক্তব্য দেন।

মানববন্ধন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিভাগের শিক্ষকদের নির্দেশনায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাবিরোধী একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করেন।