পাসপোর্টের চাহিদা বেড়েছে, বাড়েনি সক্ষমতা
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও ই-পাসপোর্ট চালু হলো ধাপে ধাপে। ফলে, বেড়েছে পাসপোর্ট আবেদনপ্রক্রিয়ার সময়। কয়েক বছরে বেড়েছে পাসপোর্ট করার হারও, বিশেষ করে ঢাকায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি লোকবল।
স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করছে জাতি। শেষ দশকে দেশে পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ২৬ লাখ, যা প্রথম ৪০ বছরের প্রায় সমান।
এমনকি করোনার দুই বছরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে। এমআরপি ও ই-পাসপোর্ট মিলিয়ে গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ। আর এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত তা ২৮ লাখ ৬০ হাজার বলে জানায় পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান। এত পাসপোর্ট ইস্যুর প্রক্রিয়ায় হিমশিম খাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা, বিশেষ করে ঢাকায়।
বর্তমানে দেশের বাইরে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোয় মূলত আবেদন হচ্ছে এমআরপির। এ সংখ্যা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ হাজার বলে জানিয়েছেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু।
আর দেশে মূলত ই-পাসপোর্ট ইস্যু হচ্ছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর আবেদনের সংখ্যা ছিল ৭ হাজারের বেশি। এর বড় অংশই ঢাকায়। ফলে, পাসপোর্ট আবেদনে ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি ঢাকার তিনটি আঞ্চলিক অফিস—আগারগাঁও, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে। আবেদনের পর ছবি তোলা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ (চোখের কালো গোলাকার অংশ) দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কয়েক মাস।
অপেক্ষা আরও বেড়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের পর। এমআরপিতে শুধু ছবি তোলা, দুই হাতের চারটি আঙুলের ছাপ নেওয়া হতো। কিন্তু ই-পাসপোর্টে ছবির পাশাপাশি সব কটি আঙুলের ছাপ নেওয়া, আইরিশ স্ক্যান করতে হচ্ছে। ই-পাসপোর্টের এ প্রক্রিয়ায় প্রতিজনের পেছনে লাগছে ৭ থেকে ৮ মিনিট, যা এমআরপিতে লাগত আরও কম।
এর বাইরে রয়েছে সংশোধন। আবেদনের পর নানা জটিলতায় ভুল ধরে প্রতিদিন দেড় হাজারের মতো আবেদন আটকে দেয় সফটওয়্যার। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসব আবেদনের হাজারখানেকের সুরাহা করতে পারেন উত্তরার ই-পাসপোর্ট অফিসের ১০ জন কর্মকর্তা। এ কারণে প্রতিদিন ঝুলে থাকে পাঁচ শতাধিক আবেদন।
পাসপোর্ট অফিসের দাবি, পর্যাপ্ত লোকবলে না পেলে শিগগির এ ভোগান্তি কমছে না। বিভাগীয়, আঞ্চলিক অফিস ও দূতাবাসগুলোয় পাসপোর্ট অধিদপ্তরের প্রায় ১ হাজার ১০০ লোক বিভিন্ন পদে কাজ করেন। পাসপোর্ট অফিসে গতি আনতে ২০১৮ সালে নতুন ১ হাজার ৯৭৭ জন নিয়োগের একটি প্রস্তাব পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এখনো তার সুরাহা হয়নি।
এ ছাড়া আগারগাঁওয়ে চাপ কমাতে এটাকে বিভক্ত করে আরেকটি আঞ্চলিক অফিস করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
বর্তমানে পাসপোর্টের ৭টি বিভাগীয় ও ৬২টি আঞ্চলিক অফিস রয়েছে বলে উল্লেখ আছে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। এ ছাড়া বিদেশের ৭২টি বাংলাদেশ মিশনেও হয় আবেদন। এতগুলো অফিসে বর্তমান লোকবল দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে সেবা দেওয়া কঠিন বলে দাবি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লোকবল বাড়েনি। এক হাজার লোক দিয়ে চালাচ্ছি। দুই হাজার লোক হলেও কোনো রকমে চালানো যেত।’
সক্ষমতার অতিরিক্ত আবেদন ঢাকায়
মীনাল আহমদ পাপুল এসেছেন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে। গ্রামের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ। কাজ করেন ঢাকার মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায়। গত ১৪ অক্টোবর আগারগাঁও অফিসের সঙ্গে দেখা হয় মীনাল আহমদের সঙ্গে। দ্রুতই কাজের উদ্দেশে বিদেশ যেতে চাইছেন তিনি; এসেছেন ছবি তোলার তারিখ এগিয়ে আনতে। এক্সপ্রেস পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন গত ৭ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তাঁর ছবি তোলার তারিখ দেওয়া হয়েছে দুই মাস পর, ৮ নভেম্বর।
সিলেটে আবেদন না করে কেন ঢাকায়—এ প্রশ্নের জবাবে মীনাল আহমদ বলেন, ‘চাকরি করি ঢাকায়। সময় লাগলেও তাই আগারগাঁওয়েই পাসপোর্ট করতে এসেছি। চাকরি ছেড়ে সিলেটে আবেদন করতে গেলে ছুটি নিতে হবে। তাই এখানেই আবেদন করছি।’
মীনালের মতো অনেকেই ঢাকায় আবেদন করতে আসেন চাকরির সুবাদে। তবে তাঁর ভাগ্য ভালো যে আবেদনের দুই মাস পর ছবি তোলার তারিখ পেয়েছেন। অনেককে তারিখ পেতে আরও সময় লাগে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগ পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, আগারগাঁওয়ে দৈনিক দেড় হাজার আবেদন গ্রহণ করে সফটওয়্যার। এর বাইরে কেউ আবেদন করলে তাঁর ছবি তোলার তারিখ পিছিয়ে যায়।
মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এই অফিসে দৈনিক আবেদনের চাহিদা আড়াই থেকে তিন হাজার। এখানে ছবি তোলা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ স্ক্যান করা হয় ২৭টি বুথে। কিন্তু যান্ত্রিক জটিলতা ও কর্মীদের ছুটির কারণে নিয়মিতভাবে কাজ হয় ২০টির মতো বুথে।
মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এখানে লোকবল বাড়ালেও জায়গা নেই। তাই যত বেশি অফিস হবে, তত ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। আরও দুটি অফিস হলে প্রতিটি অফিসে দিনে ৫০০ মানুষের সেবা দিতে পারলে সেটা সুশৃঙ্খল হতো। অফিস আলাদা করার প্রস্তাব ২০১৮ সালে দেওয়া হলেও প্রক্রিয়া মূলত ২০১৫ সাল থেকে বলে জানান ঢাকা বিভাগ পাসপোর্ট অফিসের এই পরিচালক।
অন্যদিকে, উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদনের পর ছবি তোলার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে এক থেকে দেড় মাস। উত্তরা আঞ্চলিক অফিসের উপপরিচালক শাহ মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই অফিসে দৈনিক পাঁচ শতাধিক আবেদনকারীর ছবি তোলাসহ প্রাসঙ্গিক কাজ করা হয়।
শাহ মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেন, এই অফিসে ১৩টি বুথে এসব কাজ করা হয়। স্থানস্বল্পতার জন্য আবেদনকারীদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর পর্যাপ্ত জায়গা পর্যন্ত নেই। করোনাভাইরাসের কারণে একটা দীর্ঘ সময় অফিস বন্ধ থাকায় সম্প্রতি এ চাপ আরও বেড়েছে।
শাহ মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ আরও বলেন, ‘আমার লোকবল দিয়ে দৈনিক ২৮০টি আবেদনের কাজ করতে পারি। কিন্তু বাধ্য হয়েই পাঁচ শতাধিক আবেদন নিষ্পন্ন করতে হচ্ছে।’
ঢাকার আঞ্চলিক অফিস ও উত্তরার ই-পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল না বাড়ালে নতুন পাসপোর্ট, নবায়ন ও সংশোধন—কোনোটাই শিগগির সুরাহা হচ্ছে না।