করোনার প্রভাব
নিঃস্ব হয়ে প্রবাসীদের ফেরা থামছে না
চাকরি হারিয়ে, ব্যবসার মূলধন হারিয়ে ফিরছেন অনেক প্রবাসী। আউটপাস ছাড়া দেশে ফেরা প্রবাসীদের হিসাব সরকারের কাছে নেই
ফরিদপুরের জোছনা বেগম লেবাননে যান ২০০৯ সালে। তাঁর পাঠানো টাকায় চলত সংসার। পাঁচ মেয়ের চারজনের বিয়েও দিয়েছেন বিদেশে থেকে। দুই বছর আগে থেকে কাজ কমতে থাকে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে আয়হীন হয়ে পড়েন তিনি। দেশে ফেরার পাসপোর্টও ছিল না। পাঁচ মাস আগে সংক্রমিত হন করোনায়। দেখা দেয় কিডনি সমস্যা। অবশেষে দূতাবাসের সহায়তায় গত এপ্রিলের শুরুতে দেশে ফেরেন তিনি।
জোছনা বেগম বলেন, লেবাননে অনেক দিন ধরেই অর্থনৈতিক সংকট চলছে। করোনা শুরুর পর তা আরও বেড়ে যায়। একটা টাকাও দেশে আনতে পারেননি তিনি। কয়েক মাস আগে স্বামীও মারা গেছেন। দেশে কোনো আয়ের উৎস নেই। ১১ বছর পর দেশে ফিরে এখন অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।
জোছনা বেগমের মতো অনেক প্রবাসীই নানা কারণে সমস্যায় পড়ে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফেরেন। তবে এমন নিঃস্ব হয়ে দেখা ফেরা প্রবাসীদের কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই। অবশ্য পাসপোর্ট না থাকায় যাঁরা আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফেরেন, তাঁদের হিসাব রয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের কাছে।
প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্যমতে, গত বছর আউটপাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৬৩ হাজার ৪৩৯ প্রবাসী। আগের বছর ২০১৯ সালে ফিরে আসেন ৬৪ হাজার ৬৩৮ জন। চলতি বছরও এমন খালি হাতে ফিরে আসা থামছে না। এ বছর ১৩ জুন পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ৩৬ হাজার ২১০ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিরেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর আগে ২০১৬ সালে ৪১ হাজার ৬২৬ জন, ২০১৭ সালে ৫০ হাজার ১৬৩ জন ও ২০১৮ সালে ৬৮ হাজার ৮১২ জন ফিরে আসেন আউটপাস নিয়ে।
দেশে ফেরা প্রবাসীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করা সংগঠনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে কর্মীদের পাঠানো হয়। তাঁরা বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশিত কাজ পান না। আবার কেউ কেউ ফ্রি ভিসার নামে স্বাধীনভাবে কাজ করতে মধ্যপ্রাচ্যে যান। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে নিয়োগকর্তার বাইরে কাজ করার সুযোগ নেই। তাই ইচ্ছেমতো বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দ্রুত অবৈধ হয়ে পড়েন। ধরা পড়লে পুলিশ আটক করে দেশে ফেরত পাঠায়। কেউ কেউ নিজ থেকেই দূতাবাসে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, বৈধ পথে বিদেশে গেলে এসব কমে আসবে। তাই নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। তবে যাঁরা আউটপাস নিয়ে আসেন, তাঁরা সবাই শূন্য হাতে ফেরেন না। করোনার প্রভাবে কারও কারও আর্থিক দুর্দশা অবশ্য বেড়েছে। দেশে ফেরা সবাইকে সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আউটপাসের বাইরেও অনেক প্রবাসী দেশে ফিরছেন। করোনার প্রভাবে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, যাঁরা ছোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা মূলধন হারিয়েছেন। তাই দেশে ফিরে আসছেন। গত বছর মোট কতজন প্রবাসী দেশে ফিরেছেন, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলেও এবার শুধু আউটপাস নিয়ে ফেরা প্রবাসীর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে।
কয়েক মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন ঢাকার দোহারের রোকেয়া বেগম। তাঁর মেয়ে রিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শুরুতে বিদেশে যান তাঁর মা। এরপর একবার ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। নিয়োগকর্তা নিয়মিত মারধর করায় পালিয়ে যান। মাকে দেশে ফেরানোর জন্য দালালকে ৩০ হাজার টাকা দেন। কিন্তু কাজ হয়নি। এরপর দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরেন তাঁর মা।
অভিবাসন খাতের উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, কর্মী পাঠানো নিয়ে সবাই কাজ করে। কিন্তু ফিরে আসা কর্মীদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে দেশে তেমন কোনো কাজ হয় না। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ কিছু দেশ অনেক আগে থেকে এটি শুরু করেছে। শুধু সরকার নয়, সবার এদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
দেশে ফেরা প্রবাসীরা বলছেন, তাঁরা কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না। ৫ পাঁচ বছর পর লেবানন থেকে ফেরা কুমিল্লার জসিম বলেন, বিদেশ থেকে দেনা করে টিকিটের টাকা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। খুব কষ্টে আছেন এখন। কোনো আয় নেই। সংসারও চালাতে পারছেন না।
তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে এজেন্সির ভিসা বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। যাঁরা নানা কারণে বিদেশে গিয়ে অনিবন্ধিত হয়ে পড়েন, তাঁদের তালিকা তৈরি করে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে বৈধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।