তালেবানরা আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংস্থাগুলোর ভেতরে। বিশেষ করে এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে সংগঠিত বা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কি না; সে আশঙ্কা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
সিরিয়ায় আইএসের পতন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মনোবল ভাঙার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। এখন তালেবানদের ফিরে আসাও এসব দেশে বিশেষ করে এই অঞ্চলের জঙ্গিদের অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই উদ্বেগের অনেকগুলো কারণও আছে। তবে উদ্বেগ কতটা প্রকট হবে, তা নির্ভর করছে আল-কায়েদা ও আইএসের বিষয়ে তালেবানদের নীতি কী হয়, তার ওপর। তালেবানরা এই দুই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয় অথবা আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহারের সুযোগ দিলে তার প্রভাব পুরো উপমহাদেশে পড়বে। আবার তারা আফগানিস্তানে সরকার গঠন করলে ভারত বিশেষত কাশ্মীরের বিষয়ে তাদের নীতি কী হবে, তা–ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার ভারতে জঙ্গি তৎপরতা বাড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার আশঙ্কা আছে।
অবশ্য এই আলোচনাও সামনে এসেছে যে আগের তালেবান (১৯৯৬-২০০১) আর এখনকার তালেবান এক নয়। এবারের তালেবান অনেক বেশি রাজনৈতিক। অন্য দেশের স্বীকৃতি পাওয়া এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন এবারের তালেবানদের বড় লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের মুখপাত্র ড. মুহাম্মদ নাইম ওয়ারদাক প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্য কারও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই। আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে কেউ অন্য দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে, তা তারা হতে দেবে না।
তবে সরকার গঠন করার পর তালেবানরা এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করবে, তাদের কট্টরপন্থী সদস্যদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আফগান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো ভিনদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় দিলে তা তারা বন্ধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার আল-কায়েদার সঙ্গে তালেবানদের যোগাযোগ কতটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এই অবস্থায় বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, উদ্বেগের অনেকগুলো কারণ রয়ে গেছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছে আফগানিস্তানে। সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি মুজাহিদরা কান্দাহারে বসে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জন্ম দেন। কয়েক বছর পর ১৯৯২ সালে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে তারা। পরবর্তী সময়ে আনসার আল ইসলামের মতো আল-কায়েদা মতাদর্শী জঙ্গি সংগঠনের কিছু সদস্যের আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয় ছিল। কেউ কেউ সেখানে গিয়ে নিহত হয়েছেন। এখনো কেউ কেউ সেখানে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর সেখান থেকে কোনো কোনো বাংলাদেশি আফগানিস্তানে গেছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে বিভিন্ন সময়ে খবর বের হয়েছে।
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন আফগানিস্তানে তৎকালীন তালেবান সরকারের মন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ গাউস। তখন তিনি ঢাকার একাধিক মাদ্রাসায় বক্তৃতা করেছিলেন। এমন একটি বড় মাদ্রাসার এক শিক্ষক প্রথম আলোকে জানান, মোল্লা মোহাম্মদ গাউস তখন তাঁদের মাদ্রাসার ছাত্র–শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা আপনাদের দেশের পরিবেশ–পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলন করবেন। আমাদের (তালেবানদের) অনুসরণ করলে ভুল করবেন। কারণ, আমাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।’
আনসার আল ইসলামের মতো বাংলাদেশের সালাহউদ্দিন সালেহীনের নেতৃত্বাধীন জেএমবি বা পুরোনো জেএমবির আফগানিস্তান-পাকিস্তানকেন্দ্রিক যোগাযোগ আছে। আবার তারা আল-কায়েদা অনুসারী বলেও জানা যাচ্ছে।
১৪ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কিছু মানুষ অলরেডি তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য হিজরত করেছে। কিছু মানুষ আমরা ধারণা করছি যে ইন্ডিয়ায় ধরা পড়েছে। আর কিছু পায়ে হেঁটে বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।’
অবশ্য এ ধারণা অমূলক বলে মনে করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মনে হয় এগুলো যাঁরা বলছেন, যাঁরা সন্দেহ করছেন, তাঁদের সন্দেহ সঠিক নয়।’
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতিকালে তাঁরা জঙ্গিদের বিভিন্ন অনলাইন চ্যানেল পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারছেন, কেউ কেউ আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা বা ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। তবে কেউ এরই মধ্যে গিয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।
এই মুহূর্তে দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সাংগঠনিক শক্তি–সামর্থ্য অনেকটা সীমিত। তবে তালেবানদের বর্তমান অবস্থা তাদের কিছুটা উৎসাহিত করতে পারে। কারণ, নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে এ দেশে জঙ্গিদের উত্থানের সময়টায়ও আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল তালেবান সরকার। এখন আবার তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিল।
এই অবস্থায় দেশে তাদের নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে কি না জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন। তবে সতর্ক আছেন। তাঁরা মনে করছেন, যতই চেষ্টা করুক, দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বড় কিছু করতে পারবে না। তারা কিছু ঘটানোর সক্ষমতা হারিয়েছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দক্ষতা ও প্রযুক্তিজ্ঞান অনেক বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং নজরদারিও বাড়িয়েছে।
তবে জঙ্গিদের বাইরে অনেককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালেবানদের নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। আবার দেশের ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যেও কিছুটা উচ্ছ্বাসের আভাস পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ইসলামপন্থী রাজনীতির বিশ্লেষক শরীফ মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, আফগানিস্তানের পট পরিবর্তনে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের আনন্দিত হওয়ার কারণ তালেবান আদর্শ নয়। তাঁরা মনে করে, আফগান জনগণ মজলুম, আগ্রাসী শক্তির দ্বারা নিষ্পেষিত। ২০ বছর পর আফগানিস্তান মুক্ত হয়েছে, এই আনন্দ এ দেশের ইসলামপন্থীদেরও ছুঁয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা অস্ত্র হাতে তুলে নেবে বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করবে।
অবশ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এন এম মুনীরুজ্জামান মনে করেন, যেহেতু বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের উগ্র গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক ছিল; তাই বর্তমান ও ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।