পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের মূল ফটকের সামনে কুমারটুলীর ৮ ও ৯ নম্বর জি এল গার্থ লেনের প্রায় ৩৬ কাঠা জায়গা সরকারের খাতায় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত।
এই জায়গাটিই ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি সেলিম তাঁর স্ত্রী গুলশান আরার বলে দাবি করছেন এবং দীর্ঘদিন দখলে রেখেছেন। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একে তাদের তিব্বত হল (পরিত্যক্ত দোতলা ভবন) বলে দাবি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হল উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করে আসছেন।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবুল ফজল মীর গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিব্বত হলের জায়গাটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত। তাই দখলদারের বিরুদ্ধে সরকার মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এই সম্পত্তি নিয়ে বর্তমানে তিনটি মামলা চলছে। এর একটির বাদী হাজি সেলিমের স্ত্রী। দুটি মামলা করেছেন পরেশ চন্দ্র সাহা, বাবুল চন্দ্র সাহা, নারায়ণ চন্দ্র রায়, সুবল চন্দ্র রায় ও সুবাস চন্দ্র রায়। নিজেদের মূল মালিকের উত্তরাধিকার দাবি করে এই পাঁচজন একটি মামলা করেছেন জমিটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত করার জন্য। আরেকটি মামলা তাঁরা করেছেন, হাজি সেলিমের স্ত্রীকে যেন জায়গাটি বুঝিয়ে দেওয়া না হয়।
হাজি সেলিম গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, সম্পত্তিটি তাঁর স্ত্রীর নামে ২০০২ সালে সাবকবলা রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে কেনা হয়। তবে জমিটি বুঝিয়ে দিতে জেলা প্রশাসকের বরাবর ২০০৯ সালে হাজি সেলিমের স্ত্রীর করা আবেদনে বলা হয়, জমিটি ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ খলিলুর রহমান বিশ্বাসের কাছ থেকে কেনা।
১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গার খলিলুর রহমান নামের এক ব্যক্তি এই সম্পত্তির ষোলো আনা স্বত্বের দাবি করে প্রথম মামলা করেন। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর বাবা মিলাপ বক্স মৃধা ১৯৪৫ সালে গুণেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীসহ ১৫ জনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় জমিটি কিনেছিলেন। পঁয়তাল্লিশের দাঙ্গায় তাঁর পিতা মারা যান। দলিলটিও হারিয়ে যায়। অবশ্য ১৯৯১ সালে ‘সেই দলিলে’র অনুলিপি উদ্ধার করেন খলিলুর।
১৯৯৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত খলিলুর রহমানের পক্ষে রায় দেন। পরে সরকারের পক্ষ ও অর্পিত সম্পত্তির কাস্টোডিয়ান সাব-জজ এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল ও পরে লিভ টু আপিল করেন। তবে রায় খলিলুর রহমানের পক্ষেই যায়। ২০০৩ সালে তিনি এই অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু জমিটি তিনি বুঝে পাননি।
তার আগেই ১৯৯৮ সালের মে মাসে তিনি পূর্ব জুরাইনের শামছুল হক খানের কাছে এই সম্পত্তি বিক্রি করেন (কবলা দলিল নম্বর ১৩৪৫)। দলিলে দেখা যায়, এই শামছুল হকের কাছ থেকেই স্ত্রীর নামে ২০০৫ সালে এক কোটি ২৮ লাখ টাকায় হাজি সেলিম জমিটি কেনেন।
এর পর ২০০৭ সালে ওই পাঁচ বাদী ‘হাজী সেলিমের পক্ষে’ পুরো ডিক্রি ও রায় বাতিলের দাবিতে মামলা করেন। কারণ, খলিলুর রহমানের বাবার নামে ১৯৪৫ সালে দেখানো দলিলটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় (বর্তমানে খুলনা) রেজিস্ট্রি করা। এই পাঁচজনের দাবি, দলিলটি ভুয়া। মামলাটি বর্তমানে দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নথিপত্রে দেখা যায়, হাজি সেলিম দখলে নেওয়ার আগে এই জায়গায় ‘পুলিশ ক্যাম্প’ ছিল। তাঁদের উচ্ছেদ করে জায়গাটি দখল করা হলে ২০০৯ সালে পুলিশ কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নেন। সেখান থেকে একই নম্বরের (দলিল নম্বর ২১৩৭, যার একটি ২৪/৪/১৯৪৫ এবং ৮/৫/১৯৪৫) দুটি দলিলের কপি উদ্ধার করেন। তুলনা করে দেখা যায়, দলিল দুটির গদ (বর্ণনা) ভিন্ন। অবশ্য জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে একই নম্বরে দুটি দলিল হতে পারে না।
হাজি সেলিমের স্ত্রীর করা মামলায় সরকারপক্ষের আইনজীবী রাজীব চৌধুরী। সরকারের পক্ষ থেকে এখন কৃষ্ণনগর রেজিস্ট্রি অফিস থেকে মূল দলিলের সত্যায়িত কপি আনা গেলে যাচাই-বাছাই করে এই মামলার মীমাংসা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সাবেক জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবাস ছিল এই জমিতে, নাম তিব্বত হল। ২০০৭ সালে সাবেক উপাচার্য সিরাজুল ইসলাম খান বেদখল হওয়া হলসহ সম্পত্তির তথ্য জানতে ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেন। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিব্বত হল জগন্নাথের সম্পত্তি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিব্বতসহ বেদখল ১১ হল উদ্ধারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন।
জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার শেখ রেজাউল করিম বলেন, এরশাদের শাসনামলে সাবেক জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা সেখানে থাকতেন। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁদের ওপর হামলা করে হলছাড়া করে দেয়। তবে এটি সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে হলের দলিলদস্তাবেজ নেই।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের সামনে গুলশান আরা সিটি। মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালিকানাধীন ১ দশমিক ৩২ একর জায়গার ওপর মার্কেটটি নির্মাণ করেছে হাজি সেলিমের প্রতিষ্ঠান মদিনা ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। চুক্তি অনুযায়ী, বিভিন্ন তলার নির্ধারিত ভাড়া পায় ওই ট্রাস্ট।
এই গুলশান আরা সিটির পেছনে তিব্বত হল। দোতলা ভবনটি ভেঙেচুরে একতলায় এসে ঠেকেছে। এটি এখন পরিত্যক্ত। ভবনের সামনের জায়গায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। তবে পুরো জায়গা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। জেলা প্রশাসনের নথিতে বলা হয়েছে, দুটি প্লট থাকা মোট জায়গার এক-তৃতীয়াংশ গুলশান আরা সিটি তৈরির সময় গ্রাস করে ফেলা হয়েছে।
তবে এই দখল বিষয়ে খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন এর সদস্যরা। বোর্ড অব ট্রাস্টি নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা শুধু জমি দিয়েছি। সাংসদের (হাজি সেলিম) প্রতিষ্ঠান মার্কেট তৈরি করেছে। তারাই পরিচালনা করছে। এখানে আমাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’
হাজি সেলিমের দাবি অনুযায়ী, যে খলিলুর রহমানের কাছ থেকে তিনি জমিটি কিনেছেন, তাঁর বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তিন বছর আগে তিনি মারা যান। তাঁর ছেলে ইমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, জমিটি নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। হাজি সেলিমের কাছে বিক্রির পুরো প্রক্রিয়া তাঁর বাবার নিযুক্ত আমমোক্তার আবদুল খালেক করেছেন। তবে জমি বিক্রির কোনো টাকা তাঁর বাবা কিংবা পরিবারের কেউ পাননি।
অর্পিত সম্পত্তির ২০১২ সালের ‘ক’ গেজেটের ২২ ও ২৩৫ নম্বর ক্রমিকে ৮ ও ৯ নম্বর জি এল গার্থ লেন হোল্ডিংটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত আছে। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে হোল্ডিং দুটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিল। অর্পিত সম্পত্তির মালিক সরকার।
জানা যায়, সম্পত্তিটি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি জমিদারের ছিল। পরে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা এটি ভোগদখল করে আসছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বা এর পর তাঁরা ভারতে চলে যান। ভূমি জরিপ সিএস অনুযায়ী, সরত চন্দ্র রায় চৌধুরী গং এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী সুবোধ কুমার রায় চৌধুরী গংয়ের নাম মূল মালিক হিসেবে নথিভুক্ত আছে। কিন্তু ১৯৪৫ সালে খলিলুর রহমানের বাবার করা দলিলে এঁদের কারও নাম নেই। আর সর্বশেষ সিটি জরিপে সম্পত্তিটির মালিকের নাম, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসন।
১৯৬৯ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৮ নম্বর জি এল গার্থ লেন (তিব্বত হলের একাংশ) ইজারা নেন বন্দুক ব্যবসায়ী নেছার আহমেদ। এ ছাড়া আবুল কাশেম মাঝি, মনির হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, ধীরেন্দ্র চন্দ্র শীল, নুরুল ইসলামসহ কয়েকজনকে বিভিন্ন সময় ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তাঁদের কাছ থেকে ইজারার টাকাও আদায় করেছিল জেলা প্রশাসন।
১৯৭২ থেকে ৮১ সাল পর্যন্ত নেছার আহমেদ পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করেছিলেন। গত সোমবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ইট-সুরকির দোতলা ভবনের নিচতলায় তিনি থাকতেন। ওপরে ছিল রাজস্ব কার্যালয়। আর পাশের ভবনে (৯ নম্বর জি এল গার্থ লেন) থাকত কয়েকটি হিন্দু পরিবার। তিনি বলেন, নিচতলায় আট-নয়টি কক্ষ এবং একটি বড় হলঘর ছিল। বাড়ির সামনে বড় উঠানে তিনি শাকসবজির চাষ করতেন।
২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হল উদ্ধারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। সেদিন ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে শতাধিক আহত হন। পরদিন এই প্রতিবেদক তিব্বত হলে গিয়ে দেখেন, সদর দরজায় ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যারাক’ নামে একটি সাইনবোর্ড আছে। হলের ৮ নম্বর দাগে দ্বিতল জরাজীর্ণ ভবনে একটি পুলিশ পরিবারসহ পাঁচ-ছয়জন পুলিশ এবং পাশেই নির্মিত একটি বস্তিতে ১৬টি পরিবার থাকে।
ওই আন্দোলন থিতিয়ে গেলে কিছুদিন পর এই পুলিশ পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে জায়গা দখলে নেন হাজি সেলিম। কিন্তু এত দিন এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
এবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলন!: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় হাজি সেলিম বলেছিলেন, ‘শিবির রগ কাটে, ছাত্রলীগ কবজি কাটে, মাথা কাটে’।
হাজি সেলিমের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগকে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তুলনা করায় হাজি মো. সেলিমকে ‘অশিক্ষিত, টোকাই, মূর্খ’ এবং ‘খুনি এরশাদ শিকদারের বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করে ছাত্রলীগ।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সূত্রে জানা যায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। ওই বৈঠকে হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে তাঁর দুর্নীতি ও দখলবাজি খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তিব্বত হল উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এতে যুক্ত হন। চরম আবাসনসংকটের কারণে এখন এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
জায়গাটির মালিকানার বিষয়ে জানতে চাইলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মুঠোফোনে হাজি সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলব না। যা বলার আগেই (সংবাদ সম্মেলনে) বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংসদে ছাত্রলীগের বিপক্ষে কথা বলার জন্যই একটি গোষ্ঠী আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সবাই আমার সেদিনের বক্তব্যের বাহবা দিলেও ছাত্রলীগই শুধু সমালোচনা করেছে।’
তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করতেই তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন।