
ছয় বছর আগে রাজশাহী সিটি করপোরেশন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় শুরু করেছিল তিনটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ। তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় পার হয়ে আরও তিন বছর চলে গেল। অথচ এখন পর্যন্ত একটি ভবনের কাজও শেষ হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সময়কালে পিপিপির আওতায় নগরে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে একসঙ্গে শুরু হয় ১৬ তলা ‘সিটি সেন্টার’, আটতলা ‘স্বপ্নচূড়া প্লাজা’ ও আটতলা ‘দারুচিনি প্লাজা’। কাজ শুরুর ৩৬ মাসের মধ্যে এগুলোর কাজ শেষ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় সময় বৃদ্ধি করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। বর্ধিত সময় অনুযায়ী গত বছরের ৮ আগস্ট মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু একটি ভবনেরও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি।
সিটি করপোরেশন সূত্র আরও জানায়, সিটি করপোরেশনের পুরোনো ভবনের জায়গায় নগরের সোনাদিঘির মোড়ে ১৬ তলাবিশিষ্ট সিটি সেন্টার নির্মাণের কাজ পেয়েছিল রাজশাহী-৪ আসনের সাংসদ এনামুল হকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এনা প্রোপার্টিজ। ২০০৯ সালে সিটি সেন্টারের কাজের দরপত্র আহ্বান করা হলে সাংসদের প্রতিষ্ঠানটিই একমাত্র দরপত্রটি জমা দেয়। ফলে কাজটি তারাই পায়। চুক্তি অনুযায়ী পুরো প্যাকেজের ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ সিটি করপোরেশন পাবে। বাকিটা এনা প্রপার্টিজ বিক্রি করবে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পর থেকে নির্মাণ সংস্থা সিটি করপোরেশনের প্রায় ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রাপ্য ভবনের প্রতি বর্গফুটের জন্য মাসে চার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে এনা প্রোপার্টিজের ক্ষতিপূরণের হিসাব শুরু হওয়ার কথা।
এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী সিটি সেন্টারের পাশে অবস্থিত সোনাদিঘি সংস্কার ও উন্নয়নকাজ (কমন ফ্যাসিলিটিজ) নির্ধারিত ওই ৩৬ মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে একটি মসজিদ, তথ্যপ্রযুক্তি পাঠাগার, এমফি থিয়েটার, হাঁটার পথ, ল্যান্ডস্কেপিং, দিঘির এক পাশে গ্যালারি, সাবস্টেশন, জেনারেটর ও পাম্পহাউস, দিঘির দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ের উপভাড়াটেদের পুনর্বাসন, পয়োনিষ্কাশন, ভেতরের পানি সরবরাহব্যবস্থা, সীমানাপ্রাচীরসহ আরও কিছু নির্মাণকাজ এনা প্রোপার্টিজের নিজ খরচে করে দেওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী এনা তার কোনো মালিকানাই দাবি করতে পারবে না। কিন্তু কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ কাজে তারা হাতই দেয়নি।
সিটি সেন্টারের কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী খায়রুল বাশার বলেন, ‘এনা প্রপার্টিজ কাজ ধীরগতিতে করছে। আমরা বারবার চিঠি দেওয়ার পরও তারা দ্রুত কাজ শেষ করতে পারছে না। কবে নাগাদ শেষ হবে, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।’
জানতে চাইলে এনা প্রপার্টিজের পরিচালক (কনস্ট্রাকশন) এস এস আলম শাহীন বলেন, দশম তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ১১ তলার কাজও শেষের দিকে। চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) বসানোর কাজও চলছে। তবে পুরোপুরি কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, এটা তিনি বলতে পারছেন না।
একই ধরনের চুক্তিতে নগরের নিউমার্কেট এলাকার পুরোনো কাঁচাবাজারের স্থলে দারুচিনি প্লাজা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভবনটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো শামসুজ্জামান জেভি ও আলম কনস্ট্রাকশন। তাদের পক্ষে কাজটি করছে রাকা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম। ২০০৯ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর তিন বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এই ভবনটিরও নির্মাণকাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি।
নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আটতলা ভবনের মধ্যে এক পাশের চারতলার কাজ শেষ হয়েছে। আরেক পাশের চারতলার গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাজ চলছে।
দারুচিনি প্লাজার কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুদুল আলম বলেন, সব মিলিয়ে হিসাব করলে ৪০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে। এই ভবনের কাজ শেষ হতে আরও দুই বছর লাগবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
রাজশাহী নগর ভবনের পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে আরেকটি আটতলা বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। স্বপ্নচূড়া প্লাজা নামের এই ভবনটির নির্মাণকাজও শুরু হয় ২০০৯ সালে। ভবনটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো শামসুজ্জামান জেভি ও আলম কনস্ট্রাকশন। তাদের হয়ে কাজটি করছেন ফরিদ উদ্দিন নামের এক ঠিকাদার। এই ভবনটির আটতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। কবে নাগাদ শেষ হবে, তাও কেউ জানে না। আটতলা ভবনে ওঠানামার জন্য লিফট বসানোর জন্য বেশ কিছুদিন আগে গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখনো তারা কাজ শুরু করতে পারেনি। নির্মাণকাজ তদারকের দায়িত্বে আছেন শামীম নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, কাজ চলছে। ছয় মাসের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে এসব বাণিজ্যিক ভবনকে কেন্দ্র করে সিটি করপোরেশনের আরও কিছু পরিকল্পনা ছিল। সিটি সেন্টারে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি স্টুডিও স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সিটি করপোরেশনের, স্বপ্নচূড়া প্লাজাকে ঘিরে চলছে রাজশাহী সিটি ইউনিভার্সিটি স্থাপনের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অন্যান্য কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ভবন না পাওয়ায় কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, সিটি সেন্টার ও স্বপ্নচূড়া প্লাজার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। দ্রুতই ভবনের কাজ শেষ হবে। তবে দারুচিনি প্লাজার কাজে গতি না থাকায় শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার পরও কেন জরিমানা আদায় করা হচ্ছে না? জানতে চাইলে আশরাফুল আলম বলেন, ‘যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের টাকায় ভবনগুলো নির্মাণ করছে এবং সিটি করপোরেশনের কোনো অর্থ খরচ হচ্ছে না, তাই জরিমানার বিষয়টিতে ছাড় দেওয়া হয়েছে।’