কারখানায় আগুন
ঝুঁকি কমানোর নিয়মের ৬০% মানা হয় না
৩০০ কারখানার ওপর জরিপ করেছে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর। তবে ঘাটতি উঠে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ।
অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির ক্ষেত্রে ‘উদ্বেগজনক চিত্র’ উঠে এসেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) একটি জরিপে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনের ঝুঁকি কমাতে যে বিষয়গুলো মেনে চলা দরকার, একেকটি কারখানা গড়ে তার ৬০ শতাংশই পূরণ করছে না।
দেশের মোট ৩০০টি কারখানা পরিদর্শন করে এই জরিপ করা হয়। এতে আরও উঠে আসে যে প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক সুরক্ষার গড় ঘাটতি ৫০ শতাংশ। আর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কারখানায় কাঠামোগত ঝুঁকি রয়েছে।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর জানায়, তাদের ‘চেকলিস্টে’ কারখানায় আগুন লাগার ৬৭ ধরনের ঝুঁকি নির্দেশক রয়েছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে ৭৪টি, কাঠামোগত ক্ষেত্রে ৭টি ও অন্যান্য বিষয়ে ১৮টি ঝুঁকি নির্দেশক রয়েছে। চেকলিস্টটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানগুলোর ভিত্তিতে।
নির্বাচিত তৈরি পোশাক কারখানা, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানার প্রাথমিক ঝুঁকি নিরূপণ নামের একটি প্রকল্পের অধীনে জরিপটি করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে মোট ১ হাজার ১০১টি কারখানার ঝুঁকি নিরূপণ করার কথা। এগুলোর মধ্যে ৩০০টি কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে নিয়ম না মানার এই প্রবণতা পাওয়া গেছে।
পরিদর্শনে কারখানায় নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের এই প্রকল্পের পরিচালক ও অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) সৈয়দ আবুল এহসান এবং অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (সেফটি) আব্দুল মুমিন।
আব্দুল মুমিন প্রথম আলোকে বলেন, কারখানায় আগুন লাগলে ফায়ার অ্যালার্ম (অগ্নিসংকেত ব্যবস্থা) বেজে ওঠার কথা। অনেক কারখানায় এটা থাকে না। আগুন লাগার পর তা নেভাতে কারখানায় বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা থাকতে হয়; তা–ও থাকে না।
শ্রমিকদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, খাদ্যপ্রক্রিয়াজাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৬১ হাজার ৭৬৯টি কারখানা রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, একটি কারখানার একটি তলায় আগুন লাগলে সেটা যাতে পুরো ভবনে ছড়িয়ে না পড়ে, সেটা নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকতে হয়। কারখানা ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্র বা রাসায়নিক থাকলে তাতে আগুন লেগে শ্রমিকদের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই ওই জায়গাগুলো অগ্নি প্রতিরোধক ব্যবস্থার মাধ্যমে আলাদা করে ফেলতে হয়। এমন আরও অনেক নিয়মকানুন দেশের প্রচলিত আইনেই রয়েছে।
আব্দুল মুমিন বলেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস লিমিটেডে সুরক্ষা ব্যবস্থা ভালো থাকলে আগুন এক তলা থেকে অন্য তলায় যেতে পারত না।
হাশেম ফুডসে গত বৃহস্পতিবার আগুনের ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়। তাঁদের মধ্যে একটি কক্ষেই ৪৯ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হাশেম ফুডসের কারখানার ছয়তলা একটি ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ছয়টি তলায় তা ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটি পরিদর্শন করে বলেছেন, সেখানে ফায়ার অ্যালার্মের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্মোক ডিটেক্টরও (ধোঁয়া শনাক্তের ব্যবস্থা) পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া শ্রমিকদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি বহির্গমন পথ ছিল না।
মানাবে কে
২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ২০১৪ সালে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়। এর জনবলও বাড়ানো হয়। কাজটি করা হয়েছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা দেশগুলোর চাপে। বর্তমানে অধিদপ্তরের অনুমোদিত ৯৯৩ জনবলের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৪০০। তাঁদের মধ্যে পরিদর্শক ৩১২ জন।
অধিদপ্তরের পরিদর্শকেরা ‘চেকলিস্ট’ ধরে কারখানায় শিশুশ্রম, দাহ্য পদার্থ, পর্যাপ্ত সিঁড়ি, জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নিকাণ্ড হলে তা শনাক্ত ও নির্বাপণব্যবস্থা আছে কি না, তা তদারক করেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, নিজেদের পরিদর্শনে নানা অনিয়ম উঠে এলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা কম।
যেমন গত ডিসেম্বর মাসের একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই মাসে সংস্থাটির পরিদর্শকেরা ২ হাজার ৭৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেন। এতে ৪ হাজার ৪৮৮টি অনিয়ম পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালিকপক্ষ কমপ্লায়েন্স বা সার্বিক মান অর্জনে আন্তরিক নয়। ফলোআপ রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয় না। শ্রম আইন বাস্তবায়নে তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শ্রম আদালতে মামলা করতে হয়। সেই মামলার পেছনে সময় দিতে হয়। ওদিকে তাঁদের পরিদর্শন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চাপ থাকে। আবার এত ঝক্কির পর বড় শাস্তিও দেওয়া যায় না। আইন অনুযায়ী পরিদর্শকের জরিমানার ক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শুধু সনদ দিয়ে দেয়। তারা শক্তভাবে নজরদারি করে না। নিয়মিত পরিদর্শনও করে না। এ কারণে নিরাপত্তার অভাব রয়ে গেছে। তিনি বলেন, পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। অন্য কারখানায় তা হয়নি। কারণ, অন্য কারখানাগুলোর জন্য সরকার ওইভাবে চাপ অনুভব করেনি বা চাপ দেয়নি।
‘তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা দরকার’
এদিকে শ্রম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশাল ‘চেকলিস্ট’ ধরে সব ক্ষেত্রে সেরা মান নিশ্চিত করতে গিয়ে আসলে অনেক কিছুই হচ্ছে না। এ জন্য দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় কারখানায় নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিতে বাড়তি জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, কারখানা পরিদর্শনের জন্য অধিদপ্তরের লম্বা ‘চেকলিস্ট’ অপ্রয়োজনীয়। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী ছোট ‘চেকলিস্ট’ অনুসরণ করলেই হয়। তিনি আরও বলেন, কারখানা পরিদর্শনে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিতে হবে, যাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পরিবেশ অধিদপ্তরে ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরে কেন নয়।