বৈচিত্র্যময় ও প্রভাব বিস্তারকারী বই প্রকাশ করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। অনুকরণীয় প্রকাশক হিসেবে ইউপিএল ভবিষ্যতেও তার যাত্রা বজায় রাখবে।
প্রকাশনা সংস্থাটির ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা এভাবেই ইউপিএলের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করেন। আজ শনিবার সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো ইউপিএল উৎকর্ষ পুরস্কার দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত সংগীতের পরে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ ও পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন। লেখকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, লেখকেরা না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।
ইউপিএলের চার দশকের পথপরিক্রমা তুলে ধরেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, রাজনীতি ও সমাজ, নারী সংবেদনশীলতা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা—এই তিনটি ধারায় ইউপিএল ক্রমাগত বই প্রকাশ করে গেছে। ইউপিএলের সমৃদ্ধ গ্রন্থসম্ভারে বাংলাদেশকে বোঝার দিকনির্দেশনা আছে। বাংলাদেশকে বুঝে সামনে এগোতে গেলে এই গ্রন্থসম্ভারের কাছে ফিরে আসতেই হবে।
এরপর ইউপিএলের এডপ্ট-এ-লাইব্রেরি প্রকল্প নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থের জন্য ধারণ করা ২৮ জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার ভিডিও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবে ইউপিএল। এ কাজের অংশ হিসেবে ধারণ করা ভিডিওর অংশবিশেষ দেখানো হয় অনুষ্ঠানে।
ইউপিএলকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বই প্রকাশের আগে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পাদনা করা, লেখককে রয়্যালটির টাকা নিয়মিতভাবে পৌঁছে দেওয়ার মতো বিষয় সংস্থাটি চালু করেছিল। অনুকরণীয় প্রকাশক হিসেবে ইউপিএল ভবিষ্যতেও যাত্রা বজায় রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুষ্ঠু ও সযত্নে গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ইউপিএলকে ধন্যবাদ জানান ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ইউপিএলের এমন উদ্যোগ মুগ্ধ করেছিল। ইউপিএল তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভবিষ্যতেও তা বজায় রাখবে এই প্রত্যাশা করছি।’
লেখক, সহযোগী, সুহৃদ ও পৃষ্ঠপোষকদের সম্মান জানাতে ইউপিএল উৎকর্ষ পুরস্কার দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও মৃত্তিকাবিজ্ঞানী হিউ ব্রামার পান আজীবন সম্মাননা। রেহমান সোবহান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের জন্য ইউপিএলের প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ ভরসার জায়গা। তিনি বই প্রকাশের জন্য ঝুঁকি নিতেন। সমাজের চিন্তা ও জ্ঞান বাড়াতে কাজ করেছে ইউপিএল।
সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ইউপিএল দেশের অনেক সম্ভাবনাময় লেখককে বই ছাপানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তারা প্রকাশ না করলে এসব লেখকদের অনেকের লেখাই অন্য কেউ হয়তো ছাপত না।
অসামান্য পাঠকনন্দিত বই হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। পাঠকনন্দিত বইয়ের সম্মাননা পেয়েছে শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ড. আকবর আলী খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’সহ বেশ কয়েকটি বই।
অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে আকবর আলী খান বলেন, ইউপিএল ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’র নরম মলাটের কোনো সংস্করণ বের করেনি। কিন্তু বিদেশি অনলাইন পণ্য বিক্রির ওয়েবসাইটে নরম মলাটের বইটি পাওয়া যায়। বইয়ের রয়্যালটির বিষয়ে ইউপিএলকে আরও সতর্ক হতে হবে।
বৈচিত্র্য ও সংখ্যার বিচারে বেশি গ্রন্থ রচনা করায় পুরস্কার দেওয়া হয় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়াজ জামানকে। পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ডেইলি স্টার-এর প্রকাশক ও সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, বাংলাদেশ ফোরাম ফর হেরিটেজ স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াকার এ খান, মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক প্রমুখকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
এ সময় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও লেখক মিলিয়ে ৪১টি পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ইউপিএলের ইমেরিটাস প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
পুরস্কার বিতরণীর আগে ‘উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও মাতৃভাষায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা’ শীর্ষক একটি প্যানেল আলোচনা হয়। পর্বটি সঞ্চালনা করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শায়ের গফুর, লেখক ফিরোজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার ও কথাসাহিত্যিক আন্দালিব রাশদী।
আলোচকেরা বলেন, উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। জীবন ও জীবিকার জন্য ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উৎস বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় না। তাই বলে বিশ্বায়নের যুগে বাংলাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ইংরেজিকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে বাংলাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।