জনপ্রিয় হচ্ছে একশপ ও একপে
টাঙ্গাইলের নিশাত আফরোজার বুটিক শপটি শুরুতে ছিল ফেসবুকভিত্তিক। তখন তাঁর ব্যবসা চলছিল মোটামুটি। ব্যবসা বাড়াতে একপর্যায়ে তিনি একটি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করেন। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় তা আর করা হয়নি।
পরে নিশাত স্থানীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের এক উদ্যোক্তার কাছ থেকে ‘একশপ’ নামের প্ল্যাটফর্মের কথা জানতে পারেন। সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে তিনি এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হন।
একশপের মাধ্যমে নিশাতের পণ্য এখন দেশের বিভিন্ন ই-কমার্সের ওয়েব প্ল্যাটফর্মে শোভা পায়। একশপে যুক্ত হওয়ার সুবাদে তাঁর আয়ও বেড়েছে।
‘একশপ’ একটি ই-কমার্স সেবা। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্প ২০১৯ সালে এই সেবা চালু করে। একই সঙ্গে চালু করা হয় ‘একপে’ সেবা। এ প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে অনলাইনে ফি ও বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে। একশপ ও একপে উভয় প্ল্যাটফর্ম দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এটুআই জানায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ই-কমার্স সেবা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষের পণ্য সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই একশপ প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু।
বর্তমানে একশপ প্ল্যাটফর্মে ৪৬ হাজার বিক্রেতা যুক্ত আছেন। তাঁদের অধিকাংশই গ্রামের বিক্রেতা। বিক্রেতাদের প্রায় ২৮ শতাংশ নারী। এ ছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের ১১ হাজার এজেন্ট বা উদ্যোক্তা এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত আছে।
নিশাত ২০২০ সালের শুরুতে একশপ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি অনলাইনে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, পোশাক, কাঠের গয়না ও ঘর সাজানোর পণ্য বিক্রি করেন।
নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, একশপে অ্যাকাউন্ট খুলে ছবি আপলোড থেকে শুরু করে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়, তা তিনি ইউনিয়ন পরিষদের এক উদ্যোক্তার কাছে শেখেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এখন তাঁর পণ্য অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে যাচ্ছে। তাঁর পণ্য বিক্রিও বেড়েছে। শুধু এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই তাঁর মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
কোনো বিক্রেতা তাঁর পণ্য বিক্রি করতে চাইলে নিজেই একশপে যুক্ত হতে পারেন। আবার একশপে যুক্ত কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানেও তাঁর পণ্য বিক্রির জন্য প্রদর্শন করতে পারেন। এ কাজটি বিক্রেতা নিজেই করতে পারেন। আবার এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের সহায়তা নিতে পারেন।
শুরু থেকেই একশপ প্ল্যাটফর্মে আছেন নাটোরের বড়াইগ্রাম ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা নীলা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে যাঁরা আসেন, তাঁদের অধিকাংশই নারী বিক্রেতা। তাঁর এখন থেকে একশপের মাধ্যমে মিষ্টি, নকশিকাঁথা, পোশাক ইত্যাদি পণ্য বেশি বিক্রি হয়। একশপের মাধ্যমে বিক্রির জন্য গ্রামে গিয়ে প্রচার চালানো হয়। বিক্রেতাদের পণ্য বিক্রিতে সহায়তার জন্য তিনি একশপ থেকে কিছু কমিশন পান। শুরুর দিকে পণ্য বিক্রি ও চাহিদা কম থাকলেও এখন তা বেড়ে চলছে।
এটুআইয়ের হেড অব রুরাল ই-কমার্স অ্যান্ড কমার্সিয়ালাইজেশন রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ই-কমার্স ইকোসিস্টেম তৈরিতে কাজ করছে একশপ। বেসরকারি উদ্যোগে যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের ব্যবসা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে একশপ কাজ করে। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন ক্রেতাকে এসব ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটিও একশপ করে।
একশপের ডেলিভারি ব্যবস্থাপনা আছে। করোনাকালে এই সেবা চালু হয়। যেকোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা এই সেবার মাধ্যমে নিজেদের পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মে দেশের বিভিন্ন পণ্য ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ডাক বিভাগকে যুক্ত করা হয়েছে।
এটুআই জানায়, একশপের ডেলিভারি চার্জ থেকে যে আয় হয়, তা পরিচালন ব্যয়ে যায়। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার অর্ডার আসে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানকেও একশপের ছাতার নিচে আনা হয়েছে।
দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন, তুরস্ক ও সোমালিয়া একশপের মডেল রেপ্লিকা করছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি ফিলিপাইনের একটি প্রদেশেও এই মডেল চালু হচ্ছে। দেশের বাইরে এই মডেল চালুতে জাতিসংঘ সহায়তা করছে।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রান্তিক মানুষের কাছে ই-কমার্স সেবা পৌঁছে দিতে একশপ চালু হয়। প্রান্তিক মানুষ এই সেবার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া পণ্য বেচাকেনা করতে পারছেন। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্য ডেলিভারিও করা যাচ্ছে। ফলে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
একপেতে লেনদেন বাড়ছে
সরকারি বিভিন্ন সেবাসহ বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির মতো নানান পরিষেবার বিল এখন অনলাইনে দেওয়া সম্ভব। এটি সম্ভব করার পেছনে যে প্ল্যাটফর্মটি কাজ করেছে, সেটি হলো একপে।
একপে যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে। যাত্রা শুরুর বছর একপেতে ২ হাজারটি ‘ট্রানজেকশন’ হয়। ২০২০ সালে হয় ৮ লাখ ট্রানজেকশন। ২০২১ সালে ২৪ লাখ। আর ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত একপেতে ট্রানজেকশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ। এই ট্রানজেকশনের মাধ্যমে দিনে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
একপের গ্রাহক আছে ৬ লাখ। এই সেবার মাধ্যমে জমির পর্চার বিল বেশি দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
এটুআই জানায়, একপেতে ৪০টির বেশি সরকারি সেবার ‘পেমেন্ট’ করা যায়। দেশের বাইরে থেকে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিল দেওয়া যায়।
একপেতে ২৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সেবাসহ সব ধরনের কার্ড সেবা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এটুআইয়ের কর্মকর্তা রেজওয়ানুল হক বলেন, সরকারি ফি ও পরিষেবার বিল লেনদেনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কাজ করছে একপে। এখানে একজন গ্রাহক হয়তো নির্দিষ্ট কোনো একটি ব্যাংকের মাধ্যমে তিতাস বা ডেসকোর বিল দিলেন। বিলটি ব্যাংক থেকে ডেসকো বা তিতাসের কাছে পৌঁছানোর কাজটি পেছন থেকে করছে একপে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক হয়তো জানছেন না যে তিনি একপে ব্যবহার করছেন। আবার গ্রাহক সরাসরি একপে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে নিবন্ধন করেও যেকোনো পেমেন্ট করতে পারছেন।
একপে সম্পর্কে হুমায়ূন কবীর বলেন, সরকারি বিভিন্ন ধরনের ফি ও পরিষেবার বিল দেওয়ার জন্য আগে কোনো কমন প্ল্যাটফর্ম ছিল না। একপে কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে একপের সেবার পরিধি আরও বাড়ানো হবে।