চিকিৎসকদের হয়রানি, পুলিশের বিবৃতি, ফেসবুকে সরব পুলিশ কর্তারা
কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন নিরাপত্তাচৌকিতে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন কিছু চিকিৎসক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের মন্তব্য এবং মূলধারার গণমাধ্যমে এসব মন্তব্য প্রকাশের পর সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রেক্ষাপটে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা সরব হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, পুলিশের অসদাচরণের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরপরই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো কোনো স্ট্যাটাসদাতাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন পুলিশ কর্মকর্তা লিখেছেন, ডাক্তার ও পুলিশের মধ্যকার ঐতিহ্যগত সুসম্পর্ক নষ্ট করার জন্য একটি মহল সর্বদাই ক্রিয়াশীল। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মহলটি আরও বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, যাতায়াতের সময় যাঁরা আইডি কার্ড দেখাতে পারেননি, তাঁদের যাচাই–বাছাই করা হয়েছে। পুলিশ মনে করে, চলমান বিধিনিষেধের পরিপ্রেক্ষিতে এটি করা যৌক্তিক একটি বিষয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কোনো ব্যক্তি পুলিশের নিরাপত্তাচৌকিতে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশের নজরে এসেছে। একটি ঘটনায় দেখা যায়, কারওয়ান বাজারে পুলিশ একজন গাড়িচালকের কাছে তাঁর বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চান। চালক বলেন, গাড়িটি একজন চিকিৎসকের। কিন্তু চিকিৎসক ওই সময় গাড়িতে ছিলেন না। গাড়িচালককে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হলেও তিনি ব্যর্থ হন। পুলিশ এরপর গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চায়। গাড়ির কাগজপত্রে মালিক হিসেবে যাঁর নাম উল্লেখ আছে, তাঁর সঙ্গে ওই চিকিৎসকের নাম–ঠিকানা মেলেনি। ফলে গাড়িচালকের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর গেট এলাকার একটি ঘটনা সম্পর্কেও পুলিশ ব্যাখ্যা দিয়েছে। ডিএমপি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ওই চিকিৎসক নিজের বাসা থেকে হাসপাতালের দিকে রওনা হওয়ার পর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণিসহ বেশ কয়েকটি নিরাপত্তাচৌকিতে আটকান। এতে তাঁর হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। জাহাঙ্গীর গেটের কাছে নিরাপত্তাচৌকিতেও তিনি ৩০ সেকেন্ডের মতো আটকে ছিলেন।
ডিএমপি আরও বলেছে, কোভিড মহামারির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা মেনে চলা সব নাগরিকের সমান দায়িত্ব। এসব বিধিনিষেধের বাস্তবায়নে পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনে ডিএমপি অঙ্গীকারবদ্ধ। কোনো পুলিশ সদস্য যেন কোনো অপেশাদার আচরণ না করেন, সে জন্য সব সময় তাঁর আচার-আচরণ নজরদারিতে রাখা হয়। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলছে। ডিএমপি পুলিশের কাজে নাগরিকদের সার্বিক সহায়তা করার অনুরোধ করেছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতেই পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মো. আবদুর রাজ্জাক লেখেন, ‘আমার জানামতে, চিকিৎসক বলে পরিচয়দানকারী একজন ব্যক্তি তাঁর ফেসবুকের স্ট্যাটাসে বলেছেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন অধিক্ষেত্রের জাহাঙ্গীর গেট এলাকার চেকপোস্টে পুলিশ তাঁর গাড়ি থামিয়ে তাঁকে নাকি অপমান করেছিল। পুলিশ সদস্যরা তাঁর পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাঁকে নাকি “কসাই” বলে গালি দিয়েছিল।’
কথিত ডাক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাস মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে পড়ে, যা পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলেরও নজরে আসে। এ ধরনের অভিযোগগুলো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করেন ও সংশ্লিষ্ট চেকপোস্টগুলোতে কর্তব্য পালনকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তলব করে তাঁদের কাছ থেকে অভিযোগের বিস্তারিত শোনেন।
বলাবাহুল্য, ঢাকার জাহাঙ্গীর গেট দিয়ে যাঁরা চলাচল করেন, তাঁরা মূলত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির নাগরিক হন। তাই সাধারণভাবে উচ্চতর পেশাদারি মনোভাবাপন্ন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারদেরই এসব স্থানে মোতায়েন করা হয়।
সংগত কারণেই ওই এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের অপেশাদার আচরণ আশা করা হয় না। তারপরও ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলেরা পুলিশের বড় কর্তাদের তোপের মুখে পড়েন। তাঁদের কাছ থেকে সামনাসামনি কৈফিয়ত তলব করা হয়। একই সঙ্গে কথিত ‘কসাই’ বলে গালি খাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্ট্যাটাসদাতা চিকিৎসককে ফোন করে তাঁর বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু স্ট্যাটাসদাতা পুলিশের ফোন ধরেননি।
বিষয়টির প্রাথমিক অনুসন্ধানে পুলিশের দায়িত্বশীলেরা জানতে পারেন যে ওই চিকিৎসক তাঁর কর্মস্থলে যাওয়ার সময় চার–চারটি পুলিশ চেকপোস্টের মুখে পড়েছিলেন। সব পুলিশ পোস্টেই তাঁকে পরিচয়পত্র দেখাতে হয়, ডাক্তার হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে হয়। হয়তো পুলিশের চেকপোস্টে বারবার পড়ে তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন। তাই মনের দুঃখে-ক্ষোভে একটা কিছু লিখে ফেলেছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার এই স্ট্যাটাসের নিচে মন্তব্য করেছেন অনেকে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। একজন চিকিৎসক লিখেছেন, ‘সত্যি বলতে কি ভাইয়া, মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন। আমরা যে পুলিশিং চাই, সেটা এখনো অনেক দূরে। ১৪, ১৫ তারিখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ রকম হয়রানির অনেক ঘটনা ঘটেছে। রিকশা, গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় হাসপাতাল থেকে দূরেও নামিয়ে দেওয়ার পর্যন্ত ঘটনা ঘটেছে। এটা ঠিক যে তাঁদের সবার উচিত ছিল যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা।’
দেওয়ান হাসান নামের একজন চিকিৎসক আবার লিখেছেন, ‘আমি দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষ করে এখন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করি। আমি কখনো পুলিশের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। মেক্সিকোর একটা প্রবাদ আছে, তুমি তার কাছে ভালো ব্যবহার আশা করতে পারে, যার সঙ্গে তুমি ভালো ব্যবহার করবে। অনেক সময় পদপদবি, অহেতুক আত্মসম্মান বোধ দুই পক্ষের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা একান্তই আমার নিজস্ব মত ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি।’
ফয়সাল হোসেন নুরুল ইসলাম নামের একজন ওই স্ট্যাটাসের নিচে লিখেছেন, চিকিৎসকদের শেয়ার করা স্ট্যাটাস দেখে তিনি নিজেও পুলিশের ওরপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি ছিলেন। জুরাইন থেকে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথে একজন কনস্টেবল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং স্ত্রীর চিকিৎসা–সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চান। তিনি ব্যাগ থেকে কাগজ বের করতে যাওয়ার আগেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা হাজির হন। ওই ব্যক্তি লিখেছেন, ‘সেই অফিসার নিজে এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ওয়াইফ বার্ন ইউনিটে ভর্তি?” আমি হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, “যান যান দ্রুত চলে যান আপনি।” কনস্টেবলকে বললেন, “ওনাকে যেতে দাও দ্রুত।”’
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ডাক্তার ভাই বা বোনদের কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পথে বাংলাদেশ পুলিশ কোনোভাবেই বাধা নয়, বরং সহযোগী বন্ধু। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ পুলিশ যৌক্তিক কারণ ছাড়া আপনাকে বাধাগ্রস্ত করছে না। আর যদি বাধাগ্রস্ত করেই ফেলে, তবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার বা সহকারী কমিশনারকে ফোন দিন (ইন্টারনেটে/ অ্যাপে নম্বর আছে)।’