একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন চট্টগ্রামের কাহিনি
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান চলছে, তখন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আজিজ। লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। ছোট একটি খাল অতিক্রম করছিলেন তাঁরা। হঠাৎ তাঁদের মাঝখানে এসে পড়ল পাকিস্তানিদের ছোড়া কামানের গোলা। মারাত্মক আহত হন সুবেদার আজিজ। সঙ্গে ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিসেনা। কিছুক্ষণ পরই মারা যান এই দুজন।
আগের দিন ভাটিয়ারীর কাছের একটি গ্রাম হানাদারমুক্ত হয়। ওই গ্রামেই ছিল ওই কিশোরের বাড়ি। ১৫ ডিসেম্বর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাকে ১২ ঘণ্টার জন্য ছুটি দিয়েছিলেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সেই কিশোর বলেছিল, চট্টগ্রাম শহর মুক্ত করে তবেই সে বাড়ি যাবে, তার আগে নয়। তার মৃত্যুর এক দিন পর তারই বয়সী আরেক কিশোর সেখানে উড়িয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলের ওই লড়াইয়ের কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি এক মেজর সাদা পতাকা হাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ভাটিয়ারীর ওই খালের পাড় পর্যন্ত। ‘পাকিস্তানি ওই মেজর সাদা পতাকা হাতে এসে আমাকে জানালেন, নিয়াজী তাঁদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, কাল আনুষ্ঠানিকভাবে এই আত্মসমর্পণ হবে ক্যান্টনমেন্ট ও নেভাল বেইজে,’ বলেন মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে সেদিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন এই সেক্টর কমান্ডার।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি রাতে আর শহরে ঢুকলাম না। পরদিন সকাল নয়টার আগেই আমি জনতার ভিড় ঠেলে সার্কিট হাউসে ঢুকলাম। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট ও নৌঘাঁটিতে পালাচ্ছিল। সেখানেই তাদের আত্মসমর্পণ হয়। আর সার্কিট হাউস তখন জনসমুদ্র।’
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তখনো উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। রফিকুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে আনা ছোট্ট প্যাকেটটি খুললেন। প্যাকেটে ভাঁজ করে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি তুলে নিলেন তিনি। তুলে দিলেন এক কিশোরের হাতে। সে উড়িয়ে দিল পতাকাটি।
লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার, বীর উত্তমের বর্ণনায় আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি এ রকম, দুপুরের পর থেকেই পাকিস্তানি ইউনিটগুলোকে আত্মসমর্পণের জন্য চট্টগ্রাম ক্লাবের মাঠে সমবেত করা হচ্ছিল। বিকেল সাড়ে চারটায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল। এ ছিল এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সবার অস্ত্র তাদের পায়ের কাছে রাখা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। লে. জেনারেল সাগাত সিং পাকিস্তানের সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার কমোডর জেড কামালকে নির্দেশ দিলেন তাঁর সেনাদের অস্ত্রসমর্পণের। পাকিস্তানিরা পায়ের কাছে রাখা অস্ত্র সেখানেই রেখে তিন কদম পিছে সরে গেল। এরপর ভারতীয় সেনারা ওই সব অস্ত্র সংগ্রহ করে তাদের হেফাজতে নিয়ে গেল। পাকিস্তানি সব সেনার র্যাংক ব্যাজ খুলে নেওয়া হয়। তাদের কোমরের বেল্ট অপসারিত হয়।
রফিকুল ইসলামের লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইয়ে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের লোক এবং তিন বাহিনীর ৮ হাজার ৬১৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।’
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানাতে সার্কিট হাউসের মাঠ জনসমুদ্রে রূপ নেয়। সেখানে ছিলেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন শাহ আলম। অস্ত্রের পাশাপাশি হাতে থাকত একটি ইয়াসিকা ক্যামেরা। যুদ্ধদিনেও থামেনি তাঁর ক্যামেরা। তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার নারী-পুরুষ উপস্থিত। হেলিকপ্টারযোগে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা সেখানে এসে নামলেন। আমি ছবি তুললাম। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক প্রণব বল]