ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন) আসনের আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ হেরে গেলেন। ২৩ বছর পর তাঁদের কাজী পরিবারের হাত থেকে ফসকে গেল আসনটি। এর পেছনে এলাকাবাসীর তীব্র ক্ষোভ ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে এ আসনে জিতেছেন তরুণ মুজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী। তিনি মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে নাম উঠিয়ে আলোচিত তিনি। নিক্সন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে এবং মাদারীপুর-১ আসনের সাংসদ নূর-ই-আলম চৌধুরী ওরফে লিটনের ভাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনী এলাকায় দুটি জনসভা করেছেন দলীয় প্রার্থী জাফর উল্যার পক্ষে। গত ২৬ ডিসেম্বর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আত্মীয় হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি তাঁর কোনো বিশেষ মায়া নেই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা দুই বোন আর তাঁদের সন্তান-সন্ততি ছাড়া আমার আর কোনো আত্মীয় নেই।’
কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, ভোটারের মন গলেনি। জাফর উল্যার প্রতি এলাকার মানুষের ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল।
নিক্সন চৌধুরীর জন্য কাজ করেছেন, ভোট দিয়েছেন এমন একাধিক ভোটার গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, এলাকাবাসী নিক্সন চৌধুরীকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন, তা নয়। তাঁর ভোট পাওয়ার মূল কারণ কাজী পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া বঞ্চনা, দুর্ব্যবহার থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ।
এলাকাবাসী বলেছেন, ২৩ বছর ধরে এ আসনে ছড়ি ঘুরিয়েছে ভাঙ্গার কাউলীবেড়া গ্রামের কাজী পরিবার। ১৯৯১ সাল থেকে দশম জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ আসন থেকে কাজী পরিবারের সদস্যরাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে কাজী জাফর উল্যাহর চাচা কাজী আবু ইউসুফ, ২০০১ সালে কাজী জাফর উল্যাহ নিজে এবং ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রী নিলুফা জাফর উল্যাহ সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
ভোটারদের কথা, ‘আমরা নৌকা পরিবর্তন করতে চাই না, আমরা চাই মাঝি পাল্টাতে।’
ভোট গ্রহণের দিন চরভদ্রাসন পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি গত বছর নিলুফা জাফর উল্যাহর এজেন্ট ছিলাম। এবার কাজ করছি নিক্সনের পক্ষে।’ গত পাঁচ বছরে এলাকায় কোনো উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি নৌকাতেই আছি, তবে মাঝি পাল্টাতে চাই।’
ভোটের দিন বেলা পৌনে একটার দিকে কাউলীবেড়া ইউনিয়নের পলীবেড়া ঈদগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কথা হয় দুই নারীর সঙ্গে। তাঁরা বললেন, কাউলীবেড়া থেকে মালিগ্রাম সড়কটির দিকে তাকিয়ে দেখেন, খানাখন্দে ভরা। ঠিকমতো চলাফেরা করা যায় না। বহু আবেদনের পরও গত পাঁচ বছরে এ সড়কের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। তাঁরা টাকাপয়সা চান না, এলাকার উন্নয়ন চান। এসব বিষয় মাথায় রেখেই তাঁরা ভোট দিয়েছেন।
ওই দিন বেলা দেড়টার দিকে ভাঙ্গা কালামৃধা ইউনিয়নের গোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দেখা হয় স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে। তাঁরা বুকে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু ভোট চাইছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জাফর উল্যাহর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব থেকেই ভোটে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন। জাফর উল্যাহর ওপর মানুষ ১০০ ভাগ অসন্তুষ্ট ছিল। তিনি ভালো ব্যবহার করেননি, কোনো মানুষকে মূল্যায়ন করেননি। তবে সভানেত্রী শেখ হাসিনা সভা করায় কিছু ভোট বেশি পেয়েছেন জাফর উল্যাহ। প্রধানমন্ত্রী না এলে তিনি আরও কম ভোট পেতেন।
নিক্সন চৌধুরী ভোট পেয়েছেন ৯৮ হাজার ৩০০টি। আর কাজী জাফর উল্যাহ পেয়েছেন ৭২ হাজার ২০৮টি। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৪ শতাংশ।