একাত্তরে ঢাকা মেডিকেল এবং একটি প্রসবের ইতিবৃত্ত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জন্মের সেই মুহূর্তে তাঁর বাবা পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী, আর মা গৃহবন্দী ছিলেন ঢাকা শহরেই।

মা শেখ হাসিনার কোলে সজীব ওয়াজেদ জয়। পাশে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। ছবিটি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপ–প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন সম্পাদিত ‘সজীব ওয়াজেদ জয়: সমৃদ্ধ আগামীর প্রতিচ্ছবি’ বই থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা–ইতিহাস বিষয়ে আমাদের গবেষণার অংশ হিসেবে এই লেখাটিতে আমরা বিশেষভাবে উল্লেখ করছি যুদ্ধকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি সেবার চালচিত্র এবং সেখানে ঘটে যাওয়া একটি প্রসবের ঘটনাকে। মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা–ইতিহাসের তথ্য–উপাত্তের অপ্রতুলতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মূলত নির্ভর করেছি সেই সময় ঢাকা মেডিকেলে কর্মরত চিকিৎসকদের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার এবং এ বিষয়ে নানাজনের স্মৃতিচারণার ওপর।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট দৃশ্যপট আমরা পাই সে সময় সার্জারি বিভাগে কর্মরত ডা. মতিওর রহমান এবং জরুরি বিভাগে কর্মরত ডা. শামসুদ্দীন আহমেদের বয়ানে। দুজনেই ঘটনাচক্রে সেদিন হাসপাতালে ছিলেন। ডা. মতিওর রহমান আমাদের জানান, কিছুদিন আগেই তিনি বিলেত থেকে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকার পরিবেশ ছিল থমথমে, হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও ছিল কম। মনে অজানা শঙ্কা নিয়ে সন্ধ্যাকালীন রাউন্ড শেষে যখন তিনি বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন শহরে গোলাগুলি শুরু হয় এবং তিনি হাসপাতালে আটকে যান। হাসপাতালের রেসিডেন্ট সার্জন (আরএস) ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ তখন জরুরি বিভাগে কর্মরত। তাঁরা দুজনেই আমাদের জানান, ২৫ মার্চ পেরিয়ে পরদিন ভোররাত দুইটার দিক থেকে হাসপাতালে রোগী আসতে শুরু করে। তাঁরা মনে করতে পারেন, প্রথম দিকের রোগীরা মূলত এসেছিল নীলক্ষেত–বাবুপুরা বস্তি অঞ্চল থেকে।

গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনী সে রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে নির্বিচার গুলি চালায় এবং আগুন দেয়। সে সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছিল শহীদ মিনারের কাছাকাছি ভবনটিতে। তাঁরা জানান, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ফাঁকা হাসপাতালে বানের পানির মতো রোগীর স্রোত বাড়তে থাকে। অল্প কয়জন ব্রাদার ও ওয়ার্ডবয় মিলে জরুরি চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ডা. শামসুদ্দীন। সব রোগীই গুলিবিদ্ধ থাকায় প্রয়োজনীয় এক্স–রে শেষেই তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশন থিয়েটার তখন সামাল দিচ্ছেন ডা. মতিওর রহমান, ডা. মনিরুজ্জামান এবং তাঁদের অ্যানেসথেটিস্ট সহকর্মী।

অপারেশন থিয়েটারে তখন অভূতপূর্ব দৃশ্য। পাশাপাশি তিনটি টেবিলে তিনজন রোগী, ট্রলিতে রোগী, মেঝেতে রোগী। ওয়ার্ডবয়রা ট্রলির রোগী মেঝেতে নামিয়ে ছুটছেন ইমার্জেন্সিতে। সেখানে অপেক্ষা করছে আরও রোগী। একজনের যখন অপারেশন চলছে, গুলিবিদ্ধ আরেকজন তখন কাতরস্বরে ডাকছেন।

ডা. মতিওর সেদিনের একটা বিশেষ ঘটনার কথা স্মরণ করেন। একজন গুলিবিদ্ধ রোগীর শরীর থেকে যখন তিনি গুলি বের করছেন, তখন পাশের ট্রলিতে গুলিবিদ্ধ আরেকজন রোগী তাঁকে বলছেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আমি নারায়ণগঞ্জের। আমার ঠিকানাটা একটু লিখে রাখেন। আমি যদি না বাঁচি, আমার লাশটা পাঠায়ে দিয়েন।’ কিন্তু অপারেশন শেষ করে নারায়ণগঞ্জের সেই রোগীর কাছে যখন ডা. মতিওর গেলেন, ততক্ষণে সেই রোগী মারা গেছেন। ৫০ বছর পেরিয়ে আজও সেই লোকের ঠিকানা লিখতে না পারার বেদনা তাড়িত করে ডা. মতিওরকে।

আমরা আরও জানতে পারি, সে রাতে পিলখানায় পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে আহত ইপিআর সদস্যরা রেললাইনের ঢাল বেয়ে ক্রলিং করে উঠেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ প্রান্তে রেললাইন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এফসিপিএস প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের মেসে। সেই মেসে থাকা ডা. সালেক তালুকদার, ডা. আতায়ে রাব্বী প্রমুখ সে রাতে আহত ইপিআর সদস্যদের নিয়ে আসেন জরুরি বিভাগে এবং নিজেরাও চিকিৎসায় যুক্ত হয়ে যান।

দুই রাত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর ২৭ তারিখ কারফিউ শিথিল হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা দ্রুত যাঁর যাঁর বাড়িতে চলে যান, কিন্তু অধিকাংশই আবার তাঁদের পরিবার–পরিজন নিয়ে চলে আসেন হাসপাতালে এবং আশ্রয় নেন বিভিন্ন কেবিনে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা প্রধান কারণ ছিল এই যে যুদ্ধের কোড অব কনডাক্ট অনুযায়ী হাসপাতাল আক্রমণের বাইরে থাকার কথা। ফলে হাসপাতালকে নিরাপদ ভেবে চিকিৎসকেরা সেখানেই আশ্রয় নেন। যদিও সেই যুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে হাসপাতালও নিরাপদ থাকেনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সে সময়কার পরিস্থিতির আরও বিবরণ পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেলেরই সার্জারি আউটডোরের ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হকের স্মৃতিচারণায়, যা বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ বইটিতে সংকলিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে সালমা হক সে সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এবং দেখাশোনার জন্য তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডা. আজহারও। সালমা হক জানান, কেবিনের রোগী হিসেবে তিনি সে রাতে প্রত্যক্ষ করেছেন হাসপাতালের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ট্যাংকের বহর, শুনেছেন অবিরাম গুলির শব্দ, পেয়েছেন বারুদের গন্ধ। দেখেছেন তাঁর স্বামী ডা. আজহার রক্তাক্ত অ্যাপ্রন পরে ছোটাছুটি করছেন কেবিন, ইমার্জেন্সি আর অপারেশন থিয়েটারে। উল্লেখ্য, একাত্তরের নভেম্বরে ডা. আজহারকে বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় আলবদররা তুলে নিয়ে হত্যা করে।

এই তিন চিকিৎসক সে সময় যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তা এক বিস্মৃত চিকিৎসাযুদ্ধের অংশ।

আমরা আরও জানতে পারি, যুদ্ধের পুরো সময়টিতে বিশেষ করে গুলিবিদ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতে হতো চিকিৎসকদের। কারণ, পাহারারত পাকিস্তানি বাহিনী বা ইসলামী ছাত্র সংঘের নজরে পড়লে তাঁদের মুক্তিবাহিনীর সদস্য সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হতো। ফলে গোপনে চিকিৎসকেরা এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। সন্দেহ এড়াতে অনেক গুলিবিদ্ধ রোগীকে তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি করাতেন সড়ক দুর্ঘটনার কেস হিসেবে।

২.

ঢাকা মেডিকেলের এমন একটি ত্রাসের পরিবেশের ভেতরই একাত্তরের জুলাই মাসে সেখানে সন্তানের জন্ম দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ মুজিব ২৫ মার্চ গভীর রাতে গ্রেপ্তার হলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা ছেড়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা বদল করে থাকতে থাকেন। একাত্তরের মে মাসের ১২ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মগবাজার থেকে পুরো পরিবারকে তুলে নিয়ে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখে। বাড়ির চারপাশে বাংকার করে এবং ছাদে পাহারায় থাকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা। শেখ হাসিনা তখন সন্তানসম্ভবা। তিনি তখন ছিলেন প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুফিয়া খাতুনের তত্ত্বাবধানে। ডা. সুফিয়ার স্বামী অধ্যাপক এম এ ওয়াদুদও ছিলেন স্বনামধন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং তৎকালীন পিজি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান। ধানমন্ডি ২ নম্বরে ছিল তাঁদের বাসা ও চেম্বার।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা সন্তানসম্ভবা শেখ হাসিনার গর্ভকালীন পরিচর্যার জন্য অধ্যাপক সুফিয়া খাতুনের চেম্বারে শেখ হাসিনার যাতায়াতের অনুমতি চাইলে পাকিস্তানি সেনারা তা নাকচ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা সেনা পাহারায় ডা. সুফিয়াকে ধানমন্ডি ১৮ নম্বরে নিয়ে আসেন। এভাবেই আর্মি জিপে সশস্ত্র সৈনিক পরিবেষ্টিত হয়ে শেখ হাসিনার গর্ভকালীন পরিচর্যা করেন ডা. সুফিয়া। সঙ্গে থাকতেন ডা. ওয়াদুদও।

প্রসবঝুঁকি মোকাবিলায় ডা. সুফিয়া বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, তাঁর ক্লিনিকে সিজারিয়ানসহ প্রসবকালীন জটিলতা মোকাবিলার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা তখন ছিল না। তা ছাড়া যুদ্ধ ও কারফিউ পরিস্থিতিতে চটজলদি শেখ হাসিনাকে তাঁর কর্মস্থল মিটফোর্ড হাসপাতালে স্থানান্তর করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। একপর্যায়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, শেখ হাসিনাকে ডা. সুফিয়ার স্বামী ডা. ওয়াদুদ তাঁর তত্ত্বাবধানে নিয়ে যাবেন, যাতে প্রয়োজনে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা যায়। সব রকমের জরুরি সেবার ব্যবস্থা সেখানে ছিল। পিজি হাসপাতাল সে সময় ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরই একটি অংশ। স্বাধীনতার পরে সেটি শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়।

ঝুঁকি এড়াতে প্রসবের প্রস্তাবিত তারিখের দিন দশেক আগে শেখ হাসিনাকে পুলিশি প্রহরায় ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে পাকিস্তানি বাহিনী সে সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার এবং দেখা করার অনুমতি দেয়নি। প্রথম কন্যার প্রথম সন্তান জন্মের সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছা তাঁর কাছে থাকার কোনো সুযোগই পাননি। শেখ হাসিনাকে ডা. ওয়াদুদ সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্ব দেন তাঁর অধীনে কর্মরত ডা. শাহ্‌লা খাতুনকে। শাহ্‌লা খাতুন নিজেই তখন সতর্ক জীবন যাপন করছেন। কারণ, তাঁর বড় ভাই আবুল মাল আবদুল মুহিত (পরে অর্থমন্ত্রী) প্রবাসে পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়েছেন; তাঁদের সিলেটের বাড়ি পাকিস্তানি সেনারা ভাঙচুর করেছে। পারিবারিক পরিচয় গোপন রেখে হাসপাতালে কাজ করছিলেন তিনি। ডা. শাহ্‌লা স্মরণ করতে পারেন, শেখ হাসিনার কেবিনের বাইরে তখন সর্বক্ষণ থাকত পুলিশি প্রহরা। নাজুক সেই সময়ে মাকে কাছে না পেয়ে বিমর্ষ থাকতেন শেখ হাসিনা। সেই উদ্বেগ সারাতে নানা গল্পগুজব করতেন শেখ হাসিনার ফুফু খাদিজা হোসেন। এই ফুফুর মেয়ে রোজীর সঙ্গেই পরে বিয়ে হয় শেখ জামালের, যাঁরা ১৯৭৫ সালে শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

ডা. শাহ্‌লা খাতুন স্মরণ করেন ২৭ জুলাই ১৯৭১, মঙ্গলবার দুপুরের দিকে শেখ হাসিনাকে হাসপাতালের ডেলিভারি রুমে স্থানান্তর করা হয়। ডা. ওয়াদুদ একটি চেয়ার টেনে ডেলিভারি রুমের বাইরে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পরপর শাহ্‌লা খাতুন গিয়ে তাঁকে জানিয়ে আসেন পরিস্থিতি। সে রাতেই জন্ম হয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের। শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জন্মের সেই মুহূর্তে তাঁর বাবা পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী, আর মা গৃহবন্দী ঢাকা শহরেই। আমরা জানতে পারি, ‘জয়’ নামটি শেখ হাসিনাকে প্রস্তাব করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই।

ডা. শাহ্‌লা খাতুন স্মরণ করতে পারেন, সে রাতে পরপর অনেকগুলো বোমা বিস্ফোরিত হয় ঢাকায়। একপর্যায়ে হাসপাতালের বিদ্যুৎ চলে যায়। কবি বেগম সুফিয়া কামাল একাত্তরের ডায়েরীতে ২৮ জুলাই লিখেছেন, ‘কাল রাতে ৫টা বোমার শব্দ শোনা গেছে।...আজ সকালে খবর পেলাম কাল রাত ১০টায় হাসপাতালে হাসিনার একটি ছেলে হয়েছে। আল্লাহ্ হায়াত দেন। বাচ্চা হবার সময়ও মা কাছে থাকবার অনুমতি পেল না। অমানুষ মানুষ হবে কি?’ ৩০ জুলাই সুফিয়া কামাল আবার লিখেছেন, ‘বিকালে বৌমা আর আমি হাসিনার ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। কী ভীষণ দুর্ব্যবহার যে করল ওখানের মিলিটারি পাহারাদারটা। হাসিনার মা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য গতকাল ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজ হতে কড়া নিয়ম চালু করা হলো, কোনো মানুষই আর ওদের দেখতে যেতে পারবে না। এ যে কী অমানুষিক ব্যবহার। জেলখানার কয়েদিও সাক্ষাতের জন্য সময় পায়। আল্লাহ আর কত যে দেখাবে।’ আমরা জানতে পারি, সুফিয়া কামালের এই বউমা আসলে নার্গিস জাফর, ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতার কবি সিকান্‌দার আবু জাফরের স্ত্রী।

আমরা অনেক সময়েই বিস্মৃত হই যে কত বিবিধ মাত্রার যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের রেওয়াজমাফিক প্রথম সন্তান জন্মানোর সময়ও মায়ের স্নেহস্পর্শ থেকে মর্মান্তিকভাবে বঞ্চিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। শত্রুর পাহারায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডা. এম এ ওয়াদুদ, ডা. সুফিয়া খাতুন এবং ডা. শাহ্‌লা খাতুন যুদ্ধের ভেতর একটি সন্তানের জন্ম নিশ্চিত করেছিলেন।

যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডা. ওয়াদুদ এবং ডা. সুফিয়া জানতে পারেন, আলবদররা তাঁদের হত্যার পরিকল্পনা করছে। একাত্তরের নভেম্বরে তাঁরা তাঁদের বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেছিলেন বন্ধু ডা. মনোয়ারা বিনতে রহমানের বাড়িতে।

একটি জন্মকে নিরাপদ করতে ১৯৭১-এর অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর জিপে চড়ে রোগী দেখতে যাওয়া প্রয়াত ডা. এম এ ওয়াদুদ বা ডা. সুফিয়া খাতুন যে অসমসাহসিকতা দেখিয়েছিলেন কিংবা নিজের জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে ডা. শাহ্‌লা খাতুন প্রসবের যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তা এক বিস্মৃত চিকিৎসাযুদ্ধের অংশ।

মুক্তিযুদ্ধের নানা সম্মাননা ও স্বীকৃতির অংশ হিসেবে এই চিকিৎসকদের ইতিহাসও সংরক্ষিত হওয়া জরুরি।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক ও জনস্বাস্থ্যবিদ

খায়রুল ইসলাম: ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক