আয়তনের দিক থেকে গাজীপুর দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন। কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় একেবারেই পিছিয়ে। রাস্তাঘাট, অলিগলি যে দিকে চোখ যায়, চারদিকেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় মশার উৎপাত। নেই পর্যাপ্ত সড়কবাতি। আটকে আছে রাস্তা প্রশস্তকরণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড।
রাজধানীর কাছের এই শহরটি সুন্দর হবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। ময়লা-আবর্জনা সহ্যের বাইরে চলে গেছে। মেয়র ও কাউন্সিলররা নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তাঁরা ভুলে গেছেনআমিনুল ইসলাম, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও গাজীপুর মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
সিটি করপোরেশনটির আয়তন প্রায় ৩২৯ দশমিক ৫৩ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ৩০ লাখ। শিল্পকারখানা আছে ২ হাজার। অথচ এত লোকের, এত কলকারখানার বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ এলাকা এখনো রয়ে গেছে গ্রামীণ আবহে। এসব এলাকার বাসিন্দারা কর দিলেও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ময়লা-আবর্জনা এখনো আগের মতোই আছে। মশার উপদ্রব কমাতে দু-এক দিনের মধ্যেই ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম শুরু করা হবে।
স্থানে স্থানে ময়লার স্তূপ
রাজধানীর আবদুল্লাহপুর পার হলেই টঙ্গী। গাজীপুর মহানগরের সীমানা এখান থেকেই শুরু। ময়লা-আবর্জনার শুরুটাও যেন এখান থেকেই। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুই পাশ ধরে থেমে থেমে ময়লা দেখা যায় চান্দনার ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ ভাস্কর্য পর্যন্ত। আবার চৌরাস্তা থেকে শহরে যেতে শিববাড়ি সড়ক কিংবা শহরের লক্ষ্মীপুরা, দক্ষিণ ছায়াবীথি, জোড়পুকুর, হারিনাল, রেল জংশন—সবখানেই ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা এ বাস্তবতা স্বীকার করে বলছেন, গাজীপুর যেন আবর্জনার শহর। ধুলাবালুতে একাকার অবস্থা। বর্ষায় পয়োবর্জ্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।
পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও গাজীপুর মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর কাছের এই শহরটি সুন্দর হবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। ময়লা-আবর্জনা সহ্যের বাইরে চলে গেছে। মেয়র ও কাউন্সিলররা নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তাঁরা ভুলে গেছেন।’
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মদন চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এত বর্জ্য ফেলার স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এখন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা, ঢাকা বাইপাস সড়কের মোগরখাল, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কুনিয়া বড়বাড়ি এলাকায় ফেলা হচ্ছে।
বাসাবাড়ির পাশাপাশি কলকারখানার বর্জ্যও বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী ও কোনাবাড়ী এলাকায় দুটি বিসিক শিল্পনগরী রয়েছে। বিসিকসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ২ হাজার শিল্পকারখানা আছে। এসব শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন তরল বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা উৎপন্ন হচ্ছে। তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদ ও আশপাশের খালবিলে। আর কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে কারখানার আশপাশে বিভিন্ন স্থানে। সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা বর্জ্য নিয়ে ফেলছেন রাস্তার পাশে খোলা স্থানে। সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে নষ্ট হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ।
সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ বন্ধ
গত নভেম্বরের শেষ দিকে এসে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন ওয়ার্ডের সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়নকাজ। কোথাও এলাকাবাসীর বাধায়, আবার কোথাও ঠিকাদার নিজ থেকেই কাজ বন্ধ করে দেন।
গাজীপুর বিআরটিসির উত্তর পাশের পালেরপাড়া এলাকার সড়কটি ৪০ ফুট প্রশস্ত করার জন্য শতাধিক ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙা হয়। এরপর শুরু হয় নালা নির্মাণ ও সংস্কারকাজ। পরে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকাবাসী তাঁদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একই দাবিতে টঙ্গীর এরশাদনগর, ঝাঁঝর ও পুবাইল, সালনা, কাশিমপুর, ভবানীপুরসহ প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই রাস্তাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে উন্নয়নকাজ বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার সাদত প্রথম আলোকে বলেন, নগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ হচ্ছে সবচেয়ে দূষিত নদ। ৮ বছর হয়ে গেলেও সিটি করপোরেশন এ নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা করেনি। ফলে দেশের অন্যতম শিল্প-অধ্যুষিত গাজীপুরে কলকারখানা, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে।
মশার উপদ্রব, বাতিহীন সড়ক
গাজীপুর শহর ও আশপাশের এলাকার নালা-নর্দমা ও ডোবা নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরের বাসিন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে নগরে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি।
শহরের পশ্চিম বিলাশপুর এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহীম মিয়া বলেন, সন্ধ্যা হলেই মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি দীর্ঘদিন ধরে। দ্রুত ওষুধ না ছিটালে যন্ত্রণা আরও বাড়তে থাকবে।
নগর ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় এখনো লাগেনি সড়কবাতি। সড়কবাতি না থাকায় সন্ধ্যার পর পাড়া-মহল্লায় নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেক সড়ক নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে সড়কবাতি লাগানো হয়নি। তিন-চার বছর আগে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে শতাধিক বাতির ব্যবস্থা করা হলেও সেগুলো অকার্যকর হয়ে আছে। চুরি হয়ে গেছে সৌরবিদ্যুতের অনেক প্যানেল ও ব্যাটারি।
বিতর্কিত মন্তব্য করায় সম্প্রতি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সাময়িক বরখাস্ত হন। এখন ভারপ্রাপ্ত মেয়র দিয়ে কাজ চলছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত অর্থবছরে গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি বাজেট দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেটার জন্য সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই টাকা খরচ করা হয়েছিল। এখন পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গাজীপুরে ময়লা-আবর্জনার দুর্ভোগ অনেক আগে থেকেই। ময়লা ফেলার জন্য জায়গা কেনা হচ্ছে এবং ময়লা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে মশার ওষুধ ছিটানো শুরু হবে। উন্নয়নকাজ কিছু বন্ধ থাকার পর এখন কিছু কিছু এলাকায় শুরু হচ্ছে।