বাংলাদেশ বিমানের এয়ারবাস–৩১০–এর সেদিনকার যাত্রাপথ ছিল এমন—ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে দুবাই। ফিরতি পথে দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা। কিন্তু সেদিন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ঢাকায় নামতে না নামতেই আবারও উড়তে হয় এয়ারবাসটিকে। এবার তার গন্তব্য কাঠমান্ডু।
ওই দিনের ব্যস্ত উড়ানসূচিতে কিছুটা অস্বস্তি আর অস্থিরতা তৈরি হয় দুটি পক্ষে। একটি পক্ষ এয়ারবাস—৩১০–এ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত, অন্য পক্ষটি শুল্ক গোয়েন্দার—যাঁরা এই চোরাচালানের খবর পেয়েছিলেন আগেই। ঘটনাটা ২০১৩ সালের আগস্টের। শেষ পর্যন্ত বিমানের কার্গো হোল্ডের ভেতর থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ১২৪ কেজি স্বর্ণের চালান উদ্ধার করে।
ঘটনার তিন দিন পর সন্দেহভাজনদের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এত স্বর্ণের উৎস কী? সেই চালান যাচ্ছিলই–বা কোথায়? কারা জড়িত ছিলেন পাচারকারী চক্রে? ওঠে এমন অসংখ্য প্রশ্ন।
জবাব খুঁজতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পৃথক দুটি দলের অনুসন্ধান শুরু হয়। বছরখানেকের মাথায় শুল্ক গোয়েন্দারা তাঁদের প্রতিবেদন জমা দেন। পুলিশ সময় নেয় চার বছর। তবু সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। শুধু একটা বিষয়ই পরিষ্কার হয়, রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থাকে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করে আসছিল।
বাংলাদেশে প্রতিবছর কত স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে ঢুকছে, তার কোনো হিসাব নেই। তবে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ প্রথম আলোকে জানান, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ’২১–এর মার্চ পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দা ১২৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে। ২০১৮–১৯ সালে এই পরিমাণ ছিল ১৭০ এবং ২০১৯–২০ সালে ১৮০ কেজি।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কাছে গত ১০ বছরের স্বর্ণ উদ্ধারের খতিয়ান চাইলে তাঁরা দিতে পেরেছেন ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। দেখা যাচ্ছে, ১৭টি চালানের ১০টিই এসেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে। এর বাইরে তিনটি চালান আসে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে, একটি রিজেন্টে এবং বাকি তিনটি এমিরেটস, কাতার ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে। শুল্ক গোয়েন্দা, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও অলংকার ব্যবসায়ীরা জানান, পাচারকৃত স্বর্ণের উৎস মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। বাংলাদেশ হয়ে এর গন্তব্য ভারত।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে ‘গোল্ড ওর্থ বিলিয়নস স্মাগলড আউট অব আফ্রিকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৬৭ টন স্বর্ণ আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আমদানি করেছিল। ১০ বছর পর ২০১৬ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬৬ টনে। দেশটির শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে আমদানির এই হিসাব থাকলেও আফ্রিকার দেশগুলোয় এই পরিমাণ রপ্তানির খবর নেই।
এই স্বর্ণের ভোক্তাদেশ কোনটি, এমন তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় ভারতীয় সংবাদপত্রের বেশ কিছু প্রতিবেদন। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুসহ বেশ কিছু কাগজের খবর, পাচারকৃত স্বর্ণের কেন্দ্র হয়ে উঠছে ভারত। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানাচ্ছে মূলত দুবাই থেকে অবৈধ পথে বাংলাদেশে স্বর্ণ ঢোকে, তারপর ভারতে চলে যায়।
এয়ারবাস–৩১০ থেকে উদ্ধার ১২৪ কেজি স্বর্ণের গন্তব্য কোথায়, সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে অনুসন্ধানকারীরা প্রথমেই যে প্রশ্নের জবাব খোঁজেন, তা হলো দুবাই এর বিমানবন্দরে প্লেনটি সেদিন মাত্র এক ঘণ্টা থেমেছিল। ওই সময়ের মধ্যে কীভাবে ১২৪ কেজি স্বর্ণ চালান করা হলো কার্গো হোল্ডে?
মামলার এজাহারে যা আছে
যেহেতু মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি, তাই পুরোনো কাগজপত্র অনুযায়ী ঘটনার পরপরই ঢাকা কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মোস্তফা জামাল বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেছিলেন।
মোস্তফা জামাল মামলার এজাহারে লিখেছেন, ২৪ জুলাই (২০১৩) বেলা দেড়টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের একটি বড় চালান প্রবেশ করতে যাচ্ছে তাঁদের কাছে এমন খবর ছিল। ফ্লাইটটি অবতরণের আগেই কাস্টম হাউস, ঢাকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ করে অ্যাপ্রোন, বোর্ডিং ব্রিজ–১, ইমিগ্রেশন, ব্যাগেজ বেল্ট ও গ্রিন চ্যানেলে সতর্ক অবস্থান নেন। এয়ারক্রাফটটি ২৪ জুলাই বেলা ১টা ৩৪ মিনিটে (আনুমানিক) বিমানবন্দরে বোর্ডিং ব্রিজ–১–এ অবতরণ করে। বিমানের সব যাত্রী এয়ারক্রাফট থেকে একে একে নেমে যান।
এরপর শুল্ক গোয়েন্দারা বিমানের ক্যাপ্টেন মো. আবদুল বাসিত মাহাতাব, ফার্স্ট অফিসার মো. আসিফ ইকবাল ও চিফ পার্সার মো. সাইদুল সাদির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। বিমানের সিকিউরিটি শাখার কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীসহ কাস্টমস কর্মকর্তারা বিমানের সব সিট, সিট কাভার, বারবক্স, ফুড কার্ট, খাবার রাখার জায়গা, শৌচাগারসহ গোপন জায়গাগুলো তল্লাশি করে। কিন্তু এতে কিছুই উদ্ধার হয়নি।
তল্লাশি দলে এরপর যুক্ত হন বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাদী ও নিয়াজ আহমেদ। তাঁরা এয়ারক্রাফটের ফ্রন্ট কার্গো ব্যাগেজ হোল্ড তল্লাশি করেন। এরপর বক্সের ভেতর লুকানো অবস্থায় তাঁরা কালো ও বাদামি রঙের কাপড় মোড়ানো (সেলাই করা) বেল্ট আকৃতির বস্তু দেখতে পান।
এ সময় হাজির ছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই, শুল্ক গোয়েন্দা, বিমান নিরাপত্তা, এসবি, এপিবিএনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা। তাঁদের সামনেই বিমানের হোল্ড থেকে কালো কাপড়ের ১৩টি এবং বাদামি কাপড়ের দুটিসহ সর্বমোট ১৫টি কাপড়ের বেল্টের মতো দেখতে ১ হাজার ৬৪টি স্বর্ণের বার উদ্ধার ও জব্দ করেন তাঁরা। মামলার এজাহারে বাদী লেখেন, কার্গো হোল্ড থেকে পরে ওই চালান হ্যাঙ্গার গেট অথবা অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল বা অন্য কোনো অবৈধ রুট দিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে পাচার করা হতো বলে মনে হচ্ছে।
ওই মামলায় আসামি করা হয় ১৪ জনকে। নেপালি নাগরিক গৌরাঙ্গ রোশান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিলন সিকদার, ভারতীয় নাগরিক জেসন প্রিন্স, কক্সবাজারের দরজি জসিমউদ্দীন ছাড়া বাকি সব আসামি ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
পুলিশের অভিযোগপত্রে ভারতীয় নাগরিক জেসন প্রিন্সের নাম বাদ যায়। চার বছর পর তারা ১৮ জনের নামে অভিযোগপত্র জমা দেয়।
শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত
এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মঈনুল খানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায়ই স্বর্ণ ধরা পড়ে। আলাদাভাবে কেন এই চালান নিয়ে বিস্তারিত তদন্তের তাগিদ অনুভব করল অধিদপ্তর, তার ব্যাখ্যা আছে প্রতিবেদনে। তারা বলেছে, ওই বছরের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের শাহ আমানত এয়ারপোর্টে ১০৬ কেজি ও ২৬ এপ্রিল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০৫ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়। ১২৪ কেজি ও ১০৫ কেজি স্বর্ণ এই দুই চোরাচালানিতেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এয়ারক্রাফট ব্যবহৃত হয়, স্বর্ণও লুকানোর পদ্ধতিও ছিল একই। বিমানবন্দরে কর্মরত বা এয়ারলাইনসের কারও সহায়তা ছাড়া ওই চালান ধরা প্রায় অসম্ভব ছিল।
তদন্তের অংশ হিসেবে কমিটি প্রকৌশল হ্যাঙ্গারে থাকা বিমানটি দেখতে যায়। বিমানের ইকোনমি ক্লাসের ওয়াশরুমের কমোডের ঢাকনা খুলে তাঁরা দেখেন প্লেনের গায়ে একটি ফাঁকা গর্ত। ধারণা করা হয়, এই গর্ত দিয়েই স্বর্ণের ছোট ছোট প্যাকেট কার্গো হোল্ডের প্যানেলের মধ্যে রাখা হয়েছিল। যে অংশ দিয়ে এই স্বর্ণ কার্গো হোল্ডে ঢোকানো হয়েছিল, সে অংশের প্যানেলের স্ক্রু ছিল খুব পুরোনো, প্যাঁচও কাটা। ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো জায়গা আবার স্কচটেপ দিয়ে আটকানো।
এর বাইরে এয়ারক্রাফটের অন্য যে প্যানেলগুলো, সেগুলো ছিল নতুন এবং এয়ারক্রাফটের বডির সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আটকানো। এই প্যানেলগুলো কখনো খোলা হয়েছিল বলেও মনে হয়নি তদন্ত দলের। তাঁরা বুঝতে পারেন, কার্গো হোল্ডের মরিচাযুক্ত প্যানেল আগেও চোরাচালানে ব্যবহৃত হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা এবার যে প্রশ্নের মুখোমুখি তা হলো স্বর্ণ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাল ঠিকই কিন্তু এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থার এত এত কর্মীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দর পেরোবে কী করে? খোঁজখবর করে তাঁরা জানতে পারেন, একটি মাত্র জায়গা আছে, যেখানে বাইরের কারও নজর নেই। এটি হলো বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামতের স্থান। এই জায়গাই প্রকৌশল হ্যাঙ্গার নামে পরিচিত।
প্রকৌশল হ্যাঙ্গারে শুধু বিমান বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বাংলাদেশ বিমান জানায়, কোনো এয়ারক্রাফটের যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামতের জন্য একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীর অধীনে একাধিক মেকানিক দায়িত্ব পালন করেন। তদন্ত কমিটি ধারণা করে, বাংলাদেশ বিমানের হ্যাঙ্গারের দায়িত্ব পালনকারী কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারীর সহায়তা পেয়েছে চোরাচালানি নেটওয়ার্ক।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মঈনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ বিমানের কাছে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশ বিমানের প্রকৌশল রক্ষণাবেক্ষণ উপবিভাগ জানায়, ৫ জুন ২০১২ থেকে ১১ জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত ৯ বার এয়ারক্রাফটটিকে হ্যাঙ্গারে পাঠানো হয়।
উপবিভাগের পাঠানো নথি থেকে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য পায় তদন্ত দল। একটি বিদেশি কারিগরি দল এসেছিল এয়ারবাসটির কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামতে। তাঁরা মন্তব্য করেছিলেন, এয়ারক্রাফটের টয়লেট প্যানের ফিউজলেজের মধ্যে ডাক্টের ডান পাশে একটি ফাঁকা জায়গা আছে। কোনো ভারী বস্তু বা দ্রব্য নিচে ফেলে দেওয়ার কারণে অনেকগুলো তার ছেঁড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। ভারী কিছু না ফেললে এত মোটা তার ছেঁড়ার কথা নয়। তদন্ত দল বুঝতে পারে, এই বিমান চোরাচালানের কাজে এর আগেও ব্যবহৃত হয়েছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খোঁজে শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশ
তদন্তের এই পর্বে এসে যুক্ত হয় র্যাব ও পুলিশ। ২ জানুয়ারি ২০১৪ উত্তরা, মগবাজার ও বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে র্যাব মোহাম্মদ আলী ও হোসেন আসকর লাবু নামে দুজনকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল হাসান ও সুইপিং সুপারভাইজার মো. আবু জাফরের সম্পৃক্ততার কথা বলেন। গ্রেপ্তারের পর র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় শুল্ক গোয়েন্দারা উপস্থিত ছিলেন।
অপর দুটি চোরাচালানের মামলায় গ্রেপ্তার হন বিমানের আরও দুই কর্মী। তাঁরাও বিমানকর্মীরা কী করে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছেন, সে সম্পর্কে তথ্য দেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন এয়ারক্রাফট মেকানিক আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি গ্রেপ্তার ছিলেন ১০৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের মামলায়। ওই মামলাটি তদন্ত করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
অভিযোগপত্রে পিবিআই লেখে আনিস উদ্দিন প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। তারপরও তাঁর কাছ থেকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পাস, ডিউটি পাস এবং বাংলাদেশ বিমানের পরিচয়পত্র ও দুটি সিমযুক্ত মুঠোফোন নেওয়া হয়। মেসেজবক্স পরীক্ষা করে বেশ কটি খুদে বার্তা পাওয়া যায়। এর একটিতে লেখা ২২ জে ডান পাশে ১২০, বাম পাশে ১২০। পরে তিনি স্বীকার করেন বিমানের প্রকৌশল হ্যাঙ্গারে কর্তব্যরত এয়ারক্রাফট মেকানিক মো. মাসুদের নির্দেশনায় তিনি কাজ করছিলেন। ওই এয়ারক্রাফটের সাতটি টয়লেটের কমোডের পেছনে ১৪টি কালো কাপড়ের পোঁটলায় স্বর্ণ রাখা হয়েছিল।
এর বাইরে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রকৌশল বিভাগের জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার মো. শাহজাহান সিরাজকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি শুল্ক গোয়েন্দাদের জেরায় কারা কারা এই চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নাম বলেন।
বিমানের কোন কোন কর্মী চোরাচালান সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সে সম্পর্কে সব কটি সংস্থাই নিশ্চিত হয়ে যায়। অভিযোগপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১০৫ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন ১২৪ কেজি স্বর্ণ পাচারে।
গোয়েন্দারা বলছেন, যে পদ্ধতিতে স্বর্ণ পাচার হয়েছে, সে পদ্ধতিতে অস্ত্রও পাচার হতে পারত। এমনকি বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিতে পারত।
এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামালকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিমান যেন কিছুতেই চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত না হয়, সে জন্য কর্মীদের নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে। এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ক্যামেরা লাগানো ও কর্মীদের কাজের সূচি (ডিউটি রোস্টার) নির্ধারণে সতর্কতা অনুসরণ করা হচ্ছে।
১৮ আসামির দশজনই বিমানের কর্মকর্তা–কর্মচারী
তদন্ত নিয়ে তোড়জোড়ের মধ্যেই ঘটে যায় আরেক ঘটনা। ওই স্বর্ণ নিজের দাবি করে গৌরাঙ্গ রোশান নামে এক নেপালি নাগরিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিলন শিকদারের জিম্মায় চালানটি ছাড় করার জন্য আবেদন করেন এক আইনজীবীর মাধ্যমে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ মিলন শিকদারকে গ্রেপ্তার করে। তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁর আরেক অংশীদার আবদুল বারেক তরফদারের কথা জানান। তিনিও গ্রেপ্তার হন।
মিলন তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, স্বর্ণ ছাড় করানোর জন্য গৌরাঙ্গ রোশান পাসপোর্ট ও টিকিটের ফটোকপি জমা দিয়েছেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এর বাইরে তিনি বিমানের কর্মী, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের নিচতলার ইলেকট্রনিকস পণ্যের এক দোকানদার, গাজী ভবনের একজন রেডিমেড গার্মেন্টসের মালিক, মোতালিব প্লাজার মুঠোফোন ব্যবসায়ী, মানি এক্সচেঞ্জ দোকানের মালিক, চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী, বনানীর এক ব্যক্তি ও দুজন অলংকার ব্যবসায়ীর নাম বলেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা ও ভিজিটিং কার্ড তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
মামলার অভিযোগপত্র ২০১৭ সালে জমা দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন। তাঁর আগে আরও চারজন এই মামলার তদন্ত করেন। মামলায় আসামি করা হয় যে ১৮ জনকে, তাঁদের দশজনই ছিলেন বিমানের কর্মচারী ও কর্মকর্তা।
আসামিরা ছিলেন বিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল হাসান, বিমানের সুইপিং সুপারভাইজার আবু জাফর, বিমানের এয়ারক্রাফট মেকানিক মো. মাসুদুর রহমান, মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া, মেকানিক মজিবর রহমান, জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার মো. শাহজাহান সিরাজ ওরফে বাবুল, নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোশান, তাঁর সহযোগী বাংলাদেশি সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী মিলন শিকদার, সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী আবদুল বারেক তরফদার, ব্যবসায়ী সালেহ আহম্মদ খান, বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহউদ্দিন, ব্যবসায়ী মানিক মিয়া, ব্যবসায়ী সুব্রত কুমার দাস ওরফে লিটন, ব্যবসায়ী এস এম নুরুল ইসলাম, মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী সালেহ আহম্মেদ, মো. রায়হান আলী, সিরাজুল ইসলাম ও জসিমউদ্দিন। এই জসিমউদ্দিন পেশায় একজন দরজি, তিনি এক বছরে ৩২ বার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জসিমের মতো আসামিদের অনেকেই সেদিন দুবাই থেকে খালি হাতে ঢাকায় এসেছিলেন।
গোলাম সাকলায়েন প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, গৌরাঙ্গ রোশানকে তাঁরা খুঁজে পাননি। গ্রেপ্তার করতে পেরেছিলেন নয়জনকে। বাকিরা পলাতক। তিনি বলেন, আসামিরা জামিন আবেদন করেছিলেন উচ্চ আদালতে। আদালত অভিযোগপত্র দ্রুত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি আদালতের নির্দেশ মেনে অভিযোগপত্র জমা দেন।
মামলাটি এখন পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আদালত সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে এক মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া ছাড়া সবাই জামিনে আছেন। এই মামলায় গত সাড়ে সাত বছরে ৪২ সাক্ষীর দুজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আদালত সাক্ষী হাজিরে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন।
স্বর্ণ চোরাচালান মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে কতটা? এমন প্রশ্ন ছিল আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবুর কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের মামলাগুলো গুরুত্বপূর্ণ মামলা। বিচারের রায় একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু অনেকগুলো ঝামেলা আছে। মামলার তদন্ত করতে অনেক সময় লেগে যায়। বিচার শুরুর পর সাক্ষী আসেন না। সমন পাঠিয়ে দেখা যায়, সাক্ষী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সে ঠিকানায় তিনি নেই। তাই বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা হয়।