যেকোনো দেশের কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কাজ জনগণকে আশ্বস্ত করা। বর্তমানে দেশে যে চরম বিদ্যুৎ–সংকট চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সেই কাজটিই করেছে। বলা হয়েছিল সেপ্টেম্বরে এ সংকট কেটে যাবে। শীত এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে, তখন সংকট কমবে—এমন বিবেচনা থেকেই এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ–সংকট সমাধানের পন্থা দৃশ্যমান নেই।
বিদ্যুৎ–সমস্যার মূল কারণ জ্বালানির অভাব। দেশে বিদ্যুতের জ্বালানির এ সমস্যা সৃষ্টির পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক দুটি কারণ বিদ্যমান। গত ১০ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হলেও এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি জোগানের ব্যর্থতাকে এই কর্মকাণ্ডের বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একইভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে তা সঞ্চালনের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইনও সেভাবে তৈরি হয়নি। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কর্মকাণ্ড সমন্বয়হীনতার দোষে দুষ্ট।
২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন ক্রমে কমে যেতে থাকে। অন্যদিকে দেশে শিল্পোন্নয়ন বৃদ্ধির কারণে গ্যাসের চাহিদা ক্রমে বেড়ে চলে। এসবের বিপরীতে নতুন গ্যাস মজুত আবিষ্কারের কার্যক্রম আশানুরূপ ছিল না এবং এর ফলে আগের উৎপাদনমাত্রা ধরে রাখা যায়নি। বর্তমানেও গ্যাস উৎপাদন হ্রাসের ধারা চলমান। ফলে ঘটে গ্যাসের স্বল্পতা ও তা থেকে গ্যাস–সংকট। এটিই হলো অভ্যন্তরীণ কারণ।
নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন ক্রমেই কমে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে। যদিও এর মাধ্যমে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর আশাবাদ ছিল, বাস্তবে তা বুমেরাং হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে তা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর্থিক চাপে পড়ে। আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এলএনজির দাম আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। একসময় স্পট মার্কেটে এর দাম এতটাই বেড়ে যায় যে বাংলাদেশ তা ক্রয়ের ক্ষমতা হারায় এবং সেই পরিস্থিতি এখনো বজায় রয়েছে। এদিকে কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘ মেয়াদে যে এলএনজি আমদানি করা হয়, তার পরিমাণ বাড়ানোর বাংলাদেশি প্রস্তাবে সেই দেশগুলো রাজি হয়নি। আর এটি বাংলাদেশের গ্যাস–সংকটকে ঘনীভূত করে।
যাঁরা বিজ্ঞ–অভিজ্ঞ, তাঁরা তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ সমস্যার কার্যকারণ দেখাচ্ছেন, সম্ভাব্য সমাধান বাতলাচ্ছেন। প্রশাসনের তরফ থেকে এগুলো আমলে না নেওয়ার প্রবণতাই বেশি। বিজ্ঞজনেরা যদি বলেন, ভূবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ অতি গ্যাসপ্রবণ এলাকা ও নিজস্ব গ্যাস উত্তোলন করাই সমস্যা সমাধানের মোক্ষম উপায় তখন প্রশাসনের কাছ থেকে শুনি, দেশে গ্যাস নেই, অনেক খুঁড়েছি গ্যাস পাইনি। এ থেকে বোঝা যায় যে গ্যাস ভূবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে প্রশাসনের কারও সংশ্লিষ্টতা নেই। শুধু তা–ই নয়, বিশ্বব্যাপী তেল–গ্যাস উন্নয়নে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে গ্যাস অনুসন্ধানের হার সর্বনিম্ন। আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা হয় তা জানেন না অথবা মানেন না।
এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি অনুসন্ধান কার্যক্রমের পরিকল্পনা ছক প্রস্তুত করা হয় ও তা বাস্তবায়নে কজ শুরু হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সমুদ্রে দুই দশক ধরে কোনো গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ায় গ্যাস–সংকট এত প্রকট হয়েছে। অথচ এ সময়ব্যাপী ভারত ও মিয়ানমার তাদের সমুদ্রের অংশে ব্যাপক অনুসন্ধান ও সফলতা লাভ করে। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশ আগামী ডিসেম্বরে বিদেশি তেল কোম্পানির জন্য যে ব্লক বিডিং করার পরিকল্পনা করেছে, তাকে সামনে দিয়ে চলে যাওয়া ট্রেনটিকে পেছন থেকে ধরার চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এর সফলতা নির্ভর করবে বাংলাদেশ বিদেশি কোম্পানির কাছে তার সমুদ্রকে কতটা সম্ভাবনাময় হিসেবে তুলে ধরতে পারে তার ওপর।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাতক ও ভোলার গ্যাস তুলে আনা এবং ওয়ার্কওভাবের মাধ্যমে পুরোনো কূপগুলোর ফেলে আসা গ্যাস তুলে সমস্যার আংশিক সমাধান সম্ভব। আগামী শীতে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে কয়লাচালিত কিছু বিদ্যুৎ (যেমন রামপাল, আদানি) তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু সে বিদ্যুৎ নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন চালু হবে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশাসনকে বুঝতে হবে, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা ও সংকট কম হবে বলে আশাবাদ না দিয়ে আগামী গ্রীষ্মে বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা কীভাবে মেটানো যায়, সেদিকেই তাদের মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক