দেশটা হোক সবার
এই অগ্নিঝরা বর্ষায় ঘটে যাওয়া যে গণ–অভ্যুত্থান, তার নেপথ্যে কোনো জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা অনুঘটক হিসেবে মুখ্য হয়ে উঠেছিল, এমন নয়। দীর্ঘ স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনমানুষের ক্ষোভের উদ্গীরণ এই আন্দোলনে আকার পেয়েছিল। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে স্বৈরশাসন বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে হেজেমনি জারি রাখতে চেয়েছিল, এই আন্দোলন শাসকের অনেক অনুষঙ্গের মতো সেটিকেও ছুড়ে ফেলে দেয়। ছুড়ে ফেলে দেয় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে বনিয়াদি সংগ্রাম, সেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে নিয়ে শাসকের যে অশ্লীল বেসাতি, সেটাকে। ‘চেতনা’ কথাটির গা থেকে হেজেমনির আবরণ খসে পড়ার পরে তা স্বৈরশাসনবিরোধী মানুষের মুখের ব্যঙ্গাত্মক গালিতে পর্যবসিত হয়েছিল।
আমার মতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ দাঁড়িয়েছিল অন্তত দুটি ভুল পূর্বানুমানের ওপর: ক. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে রায় দিয়েছে; এবং খ. জাতিরাষ্ট্রের সীমানা ছাপিয়ে বাঙালির অভিন্ন একটি সত্তা রয়েছে। এ দুই পূর্বানুমানই আমার বিবেচনায় ছিল অর্ধসত্য।
প্রথম পূর্বানুমানের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করা যাক। এই ভূখণ্ডের মানুষ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছেড়ে এসেছেন। তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা নিজেদের মুসলমান সত্তাকে রহিত করেছেন বা মুসলিম পরিচয় ছেড়ে এসেছেন। মানুষ বরং ওই একাত্তরেও পাকিস্তানিদের বর্বরতা দেখে শিউরে উঠে বলেছেন, ‘তারা কেমন মুসলমান যে নামাজে দাঁড়ানো আরেকজনকে গুলি করে মেরে ফেলে।’ পাকিস্তানকে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামের ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করেই বাতিল করেছেন।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমরা যারা শুভ বা কল্যাণকর বলে বিবেচনা করেছি, তারা মূলত ছিলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফুট সোলজার—শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। কিন্তু এই শ্রেণিগত ধর্মনিরপেক্ষতার আকাঙ্ক্ষা কখনোই আপামর জনমানুষের চাওয়া হয়ে ওঠেনি। সত্যি কথা হলো, জনমানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে ধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল—সেক্যুলার শাসকদল কিংবা তাদের অনুসারীদের দিক থেকে কখনোই তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জাতীয়তাবাদ তথা যেকোনো পরিচিতিনির্ভর রাজনীতির একটা সংকট হলো পরিচয় গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই একাধারে গ্রহণ ও বর্জনমূলক। যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি নয়, কিংবা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এমন সব পরিচয় ও বর্গকে পর করে, তা সে মুসলমান, বিহারি, চাকমা, যা-ই হোক না কেন।
এবারে আসা যাক দ্বিতীয় পূর্বানুমান, অর্থাৎ অভিন্ন বাঙালিত্বের প্রসঙ্গটিতে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি বলে যেসব মানুষ বাস করেন, তাঁদের মধ্যে ঐক্য ও সাদৃশ্য অবশ্যই ছিল। সীমান্তের দুই পারে বসবাসরত এসব মানুষ—বহু বছর ধরে পরস্পরের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভাগাভাগি করে চলছিলেন। সাতচল্লিশের আগে তাঁরা তো একই দেশের বাসিন্দাই ছিলেন। এমনকি সাতচল্লিশে সীমান্তরেখায় বিভাজিত হওয়ার পরও তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে দেওয়া-নেওয়ার মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়েছেন। সেই দেওয়া-নেওয়া যদিও কোনোভাবেই সহজাত ছিল না—সমপর্যায়ীও ছিল না। কিন্তু এই ঐক্য ও সাদৃশ্যের ব্যাপারটা বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে পূর্ববঙ্গ–পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার প্রতীক (আইকন) হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুবই কার্যকরভাবে সামনে নিয়ে আসে।
অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্বের দুই যুগজুড়েই যে আতঙ্ক পাকিস্তানি শাসকদের তাড়া করে ফিরছিল, তা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যেকোনো সময়েই পশ্চিমবঙ্গের, তথা ভারতের বাঙালিদের সঙ্গে মিশে যাবে। এই অঞ্চলে বিরাজমান ‘ঐক্যবদ্ধ বাংলা’র আওয়াজকে পাকিস্তানি শাসকেরা ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন এবং সেই ষড়যন্ত্র রুখতে সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের পরমুহূর্ত থেকে তাঁরা অজস্র প্রকাশনা নিষিদ্ধ, বাজেয়াপ্ত করা—এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে সময় নব্য বিকাশমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ডামাডোলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সীমান্তরেখার দুই পারের দুই বাংলার মধ্যকার ঐতিহাসিক ভিন্নতা, যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য অপরিসীম।
এবারে সেই ভিন্নতার প্রসঙ্গে আসা যাক। সীমান্তের দুই পারে ভাষাগত ঐক্য ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য সত্ত্বেও দুই বাংলার উৎপাদনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শ্রেণি গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে বড়সড় ভিন্নতা দেখা দিয়েছিল শাসনকেন্দ্র হিসেবে ব্রিটিশদের হাতে তিলোত্তমা কলকাতা গড়ে ওঠার সময় থেকে। বাংলার পুরোনো কেন্দ্র ঢাকাকে ছাপিয়ে কলকাতা হয়ে ওঠে শিক্ষা, চাকরি ও শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র। কলকাতায় যখন বেতনভোগী চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বিকশিত হচ্ছিল, গ্রামীণ পূর্ববঙ্গ তখন ছিল দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত বৃহৎ এক কৃষকসমাজ। শিক্ষা কিংবা সাহিত্যকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠার পটভূমি তখনো পূর্ববঙ্গে দেখা দেয়নি।
ভিন্নতার আরেকটি ফল্টলাইন আঁকা হয়ে গিয়েছিল শিল্প–সাহিত্যের দুনিয়ায়। বাঙালি মুসলমান লেখক-সমালোচকেরা, যাঁদের অধিকাংশই আবার পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা লক্ষ করলেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মুসলমান লেখকদের অবদান চিরাচরিতভাবে অনুক্তই রয়ে গেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার এমনটাও বলেছিলেন, বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের আসরে গেলে মনে হয় মুসলমান সাহিত্যিকেরা যেনবা বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছেন। এই বাঙালি মুসলমান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একাংশই পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, যাঁরা একাধারে দুটি পরিচয়কেই সামনে এনেছিলেন—বাঙালি ও মুসলমান।
পরবর্তী সময় পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অকস্মাৎ উত্থানের ফলে পরিচয়ের স্মারক হিসেবে ধর্ম তার গুরুত্ব হারাল। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের দাবি তুলে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। পূর্ববঙ্গের এই রাজনৈতিক অভিপ্রায় পশ্চিমবঙ্গের জনমানসকে অভিভূত করেছিল সত্য; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বজ্জনেরা একই সঙ্গে বাঙালি মুসলমানকে ঘিরে যে পুরোনো সংশয়, তা থেকে এই প্রশ্ন দাঁড় করালেন যে (পূর্ব) পাকিস্তানে কি আদৌ সাহিত্যচর্চা সম্ভব?
এই যে ভিন্নতার ঐতিহাসিক পটভূমি, তা কিন্তু সীমান্তরেখায় বিভক্ত দুই বাংলার আদান-প্রদানে গুরুতর ভূমিকা রেখেছিল। দুই বাংলার আদান-প্রদান বরাবরই ছিল অসম, উচ্চম্মন্য ও হীনম্মন্যের মধ্যকার বিনিময়, ব্রিটিশ আমলের অবিভক্ত বাংলার কালেও পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গকে ভেবেছে পাণ্ডববর্জিত এক জনপদ, যেখানে শিক্ষা, কৃষ্টি বা সহবতের কোনো ধারা তৈরি হয়নি। উল্টো দিকে পূর্ববঙ্গ ও স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশও সব সময়ই কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গকে শিল্প ও সাহিত্যে উচ্চতর ও অগ্রগণ্য জ্ঞান করে এসেছে—তাদের স্বীকৃতির আশায় থেকেছে। যদিও নানা সময়ে বাংলাদেশের লেখক-সমালোচক–বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এই কলকাতাকেন্দ্রিকতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন—তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিন্তু এই ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র সন্ধানের প্রশ্নে ঠিক ততটাই নিশ্চুপ ছিল, যতটা সরব ছিল সীমান্ত ছাড়ানো অভিন্ন বাঙালিত্বের উদ্যাপনে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান—এ দুইয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালিত্ব বাংলাদেশের শিক্ষিত মহলে পরিচয়ের স্মারক হিসেবে যে নিরঙ্কুশ নৈতিক আধিপত্য কায়েম করে, তার ভেতরে অভিন্ন বাঙালিত্বের উদ্যাপন হয়ে ওঠে একটা বড় উপাদান। ফলে যাঁরা বাংলাদেশে পরিচয়ের অপরাপর স্মারকগুলোর গুরুত্বের কথা বলতে চেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কারণে তাঁরাও বর্গ হিসেবে ‘বাঙালি’র নিরঙ্কুশতাকে খণ্ডাতে পারেননি। বাংলাদেশের বাঙালির স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা শিক্ষিত সমাজের কোথাও কোথাও থাকলেও সেটা বড় পরিসরে জায়গা পায়নি।
সে কারণেই সম্ভবত স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে নির্বাসিত এবং অধিকতর ডানপন্থীর ইসলামঘেঁষা রাজনীতি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসার পরও বাঙালিত্বের উদ্যাপন ফিকে হয়ে যায়নি; বরং নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসে নতুন ইসলামপন্থা এবং এমনকি একাত্তরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বাসনের সময়েও বাঙালিত্বের উদ্যাপন যেন আরও জোরেশোরে হয়েছে, যা খানিকটা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চাকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বানিয়ে দেওয়ার উদ্যোগের সঙ্গেই তুলনীয়।
কিন্তু এই উদ্যাপন প্রশ্নের মুখে পড়ল বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা সাংস্কৃতিক কারণে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে। ২০০৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসার পরে, দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে একের পর এক ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীরা মুখে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ জপেছেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করতে চেয়েছেন। তাঁদের সীমাহীন দমন–পীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রমে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে, যা এ বর্ষায় স্বৈরশাসনের বাঁধ ভেঙে সারা দেশকে প্লাবিত করে।
এই সময়ে পুরোনো বাঙালিত্বের স্মারকগুলোকে ছাপিয়ে প্রতিবাদের মাঠে ভিন্ন পরিচয়ের স্মারক মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র যে হেজেমনিক বয়ান দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকেরা তৈরি করেছিলেন, মানুষ সেই প্রহসনকে প্রত্যাখ্যান করে। বাঙালির ‘জাতির পিতা’ ধারণা ও স্থাপনা উভয় অর্থে ভূলুণ্ঠিত হয়। ইসলামি পরিচয়ের স্মারকবাহী ক্যালিগ্রাফি/দেয়ালচিত্র দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয়। ফিলিস্তিনের, এমনকি ইসলামি খেলাফতের পতাকা নিয়েও লোকে প্রতিবাদে শামিল হন। এই অভ্যুত্থান একই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের যেমন শাসনক্ষমতা থেকে চ্যুত করে, তেমনই তাঁদের নেপথ্যের শক্তি হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে শনাক্ত করে। ভারত বিগত শাসনামলে এই দেশের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক পরিসরে যে না-হক কর্তৃত্ব ফলিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উচ্চারিত হয়। পতিত শাসককুল ভারতকে যে ‘মহান বন্ধু’র আসনে বসিয়েছিল, তা জনমানুষ প্রত্যাখ্যান করে এবং একই সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কারণে ভারতের কাছে ‘চিরঋণী’ থাকার বয়ান। বাংলাদেশের জনমানসে ভারত এই নৈতিক কর্তৃত্ব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিন্ন বাঙালিত্বের প্রকল্পও এখানে অচল হয়ে পড়ে।
এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে এই দেশে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে পুনর্ভাবনা জরুরি। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশীয় অপরাপর সমাজের মতো বাংলাদেশেও ধর্ম এক গুরুত্বপূর্ণ গাঠনিক উপাদান। এ কথা মানতে হবে, এই সমাজের সিংহভাগ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী এবং যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাতে করে এই সরল উপসংহারে উপনীত হওয়া সংগত হবে না যে ধর্ম ও ভাষিক জাতিসত্তার দুই স্মারক—বাঙালি ও মুসলমান এ দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেই বাংলাদেশে একটি আদর্শ জাতীয়তাবাদী রাজনীতি দাঁড় করানো যাবে।
জাতীয়তাবাদ তথা যেকোনো পরিচিতিনির্ভর রাজনীতির একটা সংকট হলো পরিচয় গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই একাধারে গ্রহণ ও বর্জনমূলক। যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালি নয়, কিংবা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক—এমন সব পরিচয় ও বর্গকে পর করে, তা সে মুসলমান, বিহারি, চাকমা, যা-ই হোক না কেন। একইভাবে ইসলামি পরিচয়বাহী রাজনীতি, যা কিছুকে ইসলামবিরোধী জ্ঞান করে, তাকেই বর্জন করবে। এখন সেই সূত্রমতে বাঙালি-মুসলমানের জাতীয়তাবাদ কায়েম হওয়ার অর্থ হলো, এ দেশে যেসব মানুষ একই সঙ্গে এ দুই বর্গের নন, তাঁরা সবাই এখানে জাতীয়তাবাদের পরিসরে ‘অপর’ হয়ে উঠবেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এই অপরকরণ থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলো এই অপরকরণের সংকটে পড়েছিল, যখন কিনা সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে সেখানে অভিবাসীরা পাড়ি জমিয়েছিলেন। আজ অবধি বহু–সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র তৈরি করেও সাংঘর্ষিক পরিচয়ের রাজনীতির বিবাদ থেকে তারা মুক্তি পায়নি।
তাহলে উপায় কী? জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের রাজনীতিকে আমরা ফেলে দিতে পারব না, কিন্তু আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, তাকে যথাসম্ভব অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলা। সাম্প্রতিক সময়ে এই কথা জোরেশোরে উঠেছে যে বিগত সেক্যুলার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসনে হিজাব পরা নিয়ে, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা নিয়ে মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। সেটা নিশ্চয় অন্যায় ছিল। আবার ঠিক এ মুহূর্তে সেক্যুলার মহলে এই শঙ্কা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে যে ইসলামপন্থী রাজনীতি শক্তিশালী হলে অপরাপর ধর্মের কিংবা ধর্ম মানেনই না, এমন মানুষের জীবন ও বিশ্বাস আক্রান্ত হবে কি না; অথবা নারীরা ইসলাম অনুমোদন করেন না—এমন পোশাক পরতে পারবেন কি না।
আবার ধরুন, আদিবাসী মানুষ, যাঁরা না বাঙালি না মুসলমান, তাঁরা তো দুই খাঁড়ারই নিচে কাটা পড়বেন। কিন্তু দেশটা তো সবার। এ কথা বলা প্রয়োজন, দেশটা যতটুকু বাঙালির, ঠিক ততটুকুই ভিন্ন জাতির মানুষেরও; যতটা মুসলমানের, ঠিক ততটাই অপরাপর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মানুষেরও; যতটা পুরুষের, ঠিক ততটাই নারীর কিংবা নারী কিংবা পুরুষ নন, এমন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষেরও। রক্তস্নাত গণ–অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশকে আমরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে যদি কল্পনা করতে না পারি, তাহলে তো আবার আমাদের সংঘর্ষের চোরাপথেই ঘুরে মরতে হবে।
সাঈদ ফেরদৌস: দেশভাগ–বিষয়ক গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক