সাংবিধানিক সংস্কার কী ও কীভাবে
সরকারের প্রজ্ঞাপিত গেজেট অনুযায়ী গত ৬ অক্টোবর গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন ‘বিদ্যমান সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন’ শেষে ‘সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে’ প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবে। অর্থাৎ কমিশনের হাতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। সংবিধান সংস্কারের পদ্ধতি কী হবে—নতুন সংবিধান না সংশোধনী—তা–ও নির্ধারিত হয়নি। তবে এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক তাঁর পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেছেন রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে। তাদের প্রথম দফা দাবি হলো, ১৯৭২–এর সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নতুন সংবিধান তৈরির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব গণপরিষদ বা সংবিধান পরিষদের। সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকে সংসদের হাতে। ১৯৭২ সালের সংবিধান সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতিরূপে বেছে নেয়।
জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চার মৌলনীতি সাংবিধানিক পরিচিতির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
সংবিধান নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা প্রদান করে এবং হাইকোর্ট বিভাগকে তা বলবৎকরণের ক্ষমতা প্রদান করে।
একটি প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সংবিধানের যাত্রা, তা দুই বছরের মধ্যে ব্যর্থতায় পতিত হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির চতুর্থ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে একদলীয় বাকশালি ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। রাতারাতি একনায়কতন্ত্র তথা শক্তিশালী রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার স্থগিত করা হয় এবং বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রপতির আজ্ঞাবহ করা হয়।
এই যে বড় পরিবর্তন বা সাংবিধানিক অধঃপতন ঘটানো হলো, তা কি ১৯৭২–এর সংবিধানের দুর্বলতার জন্য? আমি মনে করি, এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে কিছু সাংবিধানিক ও সংবিধানবহির্ভূত বিষয়ের কারণে। প্রথমত, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী নেতৃত্বের অপব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ তাদের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা অপব্যবহার করেছিল। তৃতীয়ত, সংবিধান সংশোধনের নিয়মসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ১৪২ ত্রুটিপূর্ণ ছিল।
ওই ব্যবস্থায় সংবিধানের মৌলিক বিষয় সংশোধনের আগে গণভোট নেওয়া বা জনগণের বড় পরিসরে মতামত নেওয়ার বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল। চতুর্থত, অনুচ্ছেদ ৭০, তথা দলের বিপক্ষে ভোট প্রদানসংক্রান্ত বাধানিষেধের কারণে সংসদে কোনো বিরোধী মত উত্থাপিত হয়নি। পঞ্চমত, শাসক দলের অভ্যন্তরে কোনো গণতন্ত্র ছিল না এবং দলনেতার আত্মীয়স্বজনের অনৈতিক চাপ ছিল ‘এক নেতা এক দেশ’ পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে।
চতুর্থ সংশোধনীর পাসের সাত মাসের কম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নির্মমভাবে খুন হন ১৯৭৫–এর ১৫ আগস্টে। তখন থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূলত সামরিক জান্তাদের শাসনামল ছিল। এ সময়ে দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়েছিল।
১৯৭৫–১৯৯০ সময়কালে সংবিধান ও সাংবিধানিক ব্যবস্থায় কিছু আশাব্যঞ্জক সংস্কার করা হয়। যদিও তখন গণতন্ত্র অনুপস্থিত ছিল, আর প্রতিটি নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং সরকার পক্ষের সাজানো ও প্রভাবিত। সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া, দুই সেনাশাসকের নিজেদের দল (বিএনপি ও জাতীয় পার্টি) গঠনের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—চার মৌলিক নীতির পরিবর্তন ও পরিমার্জন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন হয়, যার কারণে আদিবাসী ও অবাঙালি জনগোষ্ঠী কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। বিতর্কিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মরূপে স্বীকৃতির কারণে ইসলামপন্থী দলগুলো সন্তুষ্ট হয়। তবে শাসকগোষ্ঠী এসব পরিবর্তন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই করেছিল।
আরেকটি লক্ষণীয় সংস্কার ছিল সংবিধান সংশোধনের নিয়মে। সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনসহ কিছু মৌলিক বিষয়ের সংশোধনীর জন্য গণভোটের নিয়ম করা হয়।
এ সময়ে রাজনৈতিক বহুত্বের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার ভিত্তিতে স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় আন্দোলনের কারণে ১৯৯০–এর ডিসেম্বরে স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগ করেন। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১–এর ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপি সরকার গঠন করে আর আওয়ামী লীগ একটা শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাজনৈতিক সব পক্ষ দেশের ইতিহাসে প্রথম এবং শেষবারের মতো একমত হয়ে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে। একই সংশোধনীতে কিছুটা পরিমার্জন সাপেক্ষে সংবিধানের সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোটের নিয়ম রেখে দেওয়া হয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলেও ১৯৯১–এর বিএনপি সরকার তাদের মেয়াদের শেষের দিকে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করার কাজে হাত দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুনরায় ক্ষমতায় আসা। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান, সংগ্রাম ও দৃঢ় দাবির কারণে বিএনপি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সৃষ্টি করে।
সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীন অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। সেই সরকারের স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। পরবর্তী নির্বাচন ২০০৬ সালে হওয়ার কথা। কিন্তু ২০০৪–এর দিকে বিএনপি চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স বৃদ্ধি করে নেয়। বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে পাওয়া। আওয়ামী লীগ বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হওয়ার বিরোধিতা করলে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়।
সেনাবাহিনীর পরোক্ষ হস্তক্ষেপে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান–বর্ণিত ৯০ দিনের পরিবর্তে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮–এর ডিসেম্বরে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে।
আমরা দেখেছি, ১৯৯১, ২০০১, ২০০৬ ও ২০০৮–এর নির্বাচনে প্রতিবারই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। কোনো দল পরপর দুবার ক্ষমতায় আসেনি। ২০০৮–এর নির্বাচনের পর ২০০৯–এর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর ধীরে ধীরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভাবিত ও কলুষিত করার কাজে হাত দেন।
একপর্যায়ে অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক ও একপক্ষীয়ভাবে সংবিধান থেকে ২০১১ সালের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। তারা আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বিরোধী দলকে বিতাড়নের কাজটি করে। ২০১০ সালে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এবং তাঁর গোপন ও স্বার্থান্বেষী তৎপরতার কারণে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৪ বনাম ৩ বিচারপতির রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। অনেকটা বিনা ভোটে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে সরকার গঠন করে। সেই সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। জাতীয় পার্টিকে জোর করে নির্বাচনে আনা হয়েছিল এবং নির্বাচনের পর তারা সরকারের অংশীদাররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
অনেকটা বিনা পরিশ্রমে ও সংবিধানের পরিবর্তন ও সংশোধন ছাড়াই দেশ আবারও একদলীয় শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করে। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। দলে এবং দলের বাইরে প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁর একক কর্তৃত্ব ও তুষ্টিবাদ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বিগত দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনা একনায়ক হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হয় সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক খাতে।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনগুলোসহ সব স্থানীয় নির্বাচন জালিয়াতি, লুটপাট ও কারচুপির মাধ্যমে সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংস করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে মাত্র ৬–৭টি আসন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক খাতে বিরোধী দলগুলোকে দমন–নির্যাতন ও কর্মীদের গুম–খুনের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করা হয়। আর্থিক খাতে নিজেদের আত্মীয়স্বজন এবং কিছু লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। যেকোনো স্বৈরশাসকের মতো ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও প্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সীমাহীন আর্থিক ও অন্যান্য দুর্নীতিকে উৎসাহ ও প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের সাবেক কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক কমিশনারকে রাজনীতির বাইরে থেকে নিয়ে এসে রাষ্ট্রপতির পদে বসানো হয়।
এই ব্যবস্থা একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা পরস্পরবিরোধী ব্যবস্থা। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভা কেউ–ই সংসদের কাছে দায়বদ্ধ নয়। রাষ্ট্রের বিচারিক ক্ষমতা বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের কাছে অর্পণ করা হয়েছে। কাজেই নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে এক ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করাটা ক্ষমতায় বিভাজন নীতির পরিপন্থী।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সমমর্যাদায় নির্বাহীদের মধ্যে প্রথম স্থানের। এই নীতির ব্যত্যয় হয়েছে আমাদের বর্তমান সংবিধানে। অন্যদিকে এক ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। ১৯৭২–এর সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় ওই ব্যবস্থার ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সিনিয়র সদস্যরা অনাস্থা ভোটে সংসদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের ক্ষমতাকে প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ বলে মত দিয়েছিলেন।
কিন্তু এটা সবার জানা রয়েছে যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংসদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। সংসদের এই অক্ষমতার পেছনে অনুচ্ছেদ ৭০–এর বাধানিষেধ, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রহীনতা এবং পরিবার ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতি ইত্যাদি কারণ উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে সংবিধান রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক অবশ্যপালনীয় মৌলিক নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করেনি। এটিও একটি উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নিশ্চিত করা ও সংসদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অনুচ্ছেদ ৭০ তথা সাংসদদের স্বাধীনভাবে মত ও ভোট প্রদানের ওপর বিদ্যমান বাধানিষেধ সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে হবে। আর দুটো বিষয়ে সংস্কার নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি ও সংসদের ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি। প্রথমটি হলো, কোনো ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের বেশি না থাকার বিধান এবং সংসদের মেয়াদ পাঁচ থেকে কমিয়ে চারে নির্ধারণ। দ্বিতীয়টি হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণ পদ্ধতি গণতন্ত্রায়ণ করা এবং তা সংবিধানে তা সুরক্ষা করা।
একটি ভিন্ন কিন্তু মৌলিক বিষয়ে বর্তমান সংবিধানের দুর্বলতা নিয়ে আলাপ করা জরুরি। বিষয়টি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি কর্তৃত্ববাদী ধারণা এবং তা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র ও সাংবিধানিকতার পরিপন্থী। ১৯৭২–এর সংবিধান আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অবাঙালি সব জাতিকে স্বীকৃতি প্রদানে শুধু ব্যর্থই হয়নি, তাদের জাতি গঠনের প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক জনগণের ধারণার আওতা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯৭৩ বা তার পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রাম বা তৎপরতা সেই সাংবিধানিক বঞ্চনার একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল।
অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতায় ভারসাম্য করা হয়নি। এই অভিমতের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য করার প্রয়োজন নেই। আমাদের সংবিধানে ক্ষমতার বিভাজন ও ভারসাম্যের ঘাটতি রয়েছে আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে। বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় বিচার বিভাগ তার ক্ষমতা ও কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারে না। বিচারকদের নিয়োগ এককভাবে দলীয় সরকার বা প্রকৃতপক্ষে সরকারপ্রধানের ওপর রাখা আছে। এ কারণে বিচারকদের অপসারণের ক্ষেত্রেও সরকারপ্রধানের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারে। বাস্তবে বিগত বছরগুলোতে বিচারকদের অপসারণ করা বা না–করার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে।
তাই বলতে দ্বিধা নেই, সংবিধানের কিছু অন্তর্নিহিত ঘাটতি প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তবে আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের সরকারের সঙ্গে নব্বই–পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের তুলনা করলে অন্য একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠবে। একই সংবিধানের অধীন ১৯৯৬ থেকে ২০০১–এর শেখ হাসিনার সরকার স্বৈরাচারী ছিল না। ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার এক–দুই বছর পর থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সুচতুরভাবে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে গেছেন। সংবিধানের সংশোধনী প্রক্রিয়ায় যে গলদ মূল সংবিধানে ছিল, তা প্রথমে জিয়ার আমলে এবং পরে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে সংশোধন করা হয়েছিল। সংবিধানের কিছু কিছু বিধান বিশেষ করে সংশোধনের প্রক্রিয়াসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ১৪২ সংশোধনের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে গণভোটের বিধান করা হয়েছিল। এ বিধান বলবৎ থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকার তা অগ্রাহ্য করে বেআইনিভাবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের কিছু মৌলিক বিধান সংশোধন বা বিলোপ করেছিল। এর বড় উদাহরণ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ, যা মূলত সংবিধানের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতারণা। শুধু আওয়ামী লীগ নয়। বিএনপিও নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ এবং বিরোধীদের ঘায়েল করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করেছিল। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় সংস্কার তাই বিশেষভাবে বিবেচ্য হওয়া উচিত।
নতুন সংবিধান তৈরির যে দাবি বর্তমান জনপরিসরে চালু রয়েছে, তাতে অবশ্য পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা নেই। একটি গণপরিষদ গঠন ব্যতিরেকে নতুন সংবিধান তৈরির কোনো সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমার এই অবস্থানের পক্ষে প্রথম যুক্তি হলো জুলাইয়ের বিপ্লবের শক্তি ও কারণ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ বিপ্লবের (স্বাধীনতার) শক্তি ও কারণ থেকে ভিন্ন। ১৯৭১–এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত গণপরিষদের (সংসদ নয়) মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম। ১৯৭২–এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগের সময়ে গণপরিষদ কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে কাজ করেছিল। আগেই বলেছি ওই গণপরিষদ নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল।
নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় উদ্ভূত দাবি অনুযায়ী নতুন সংবিধান তৈরি অথবা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সাংবিধান সংস্কার করতে হলে আমাদের এখনই একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে যেতে হবে। সাংবিধানিক রাজনীতি ও শাসনের জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলো ‘সাংবিধানিক জনগণের’ তথা নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করে জনগণের এজেন্ট হিসেবে। রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং তারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যম।
কাজেই টেকসই সাংবিধানিক সংস্কারের স্বার্থে আমাদের সব রাজনৈতিক দলকে একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে উপনীত হতে হবে দুটি বিষয়ে। প্রথমত, তারা সংবিধানের কী কী সংস্কার চায়, সে বিষয়ে ঐকমত্য। দ্বিতীয়ত, সেই সংস্কার কোন পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নতুন সংবিধান প্রণয়ন নাকি সংবিধানের সংশোধন—সেই বিষয়ে ঐকমত্য। রাজনৈতিক দলগুলো উৎসাহিত ও একত্র করার কাজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ভূমিকা রাখতে পারে। সব পক্ষ এক হলে আগামী নির্বাচনের আগেই একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে কাজ শুরু করা যেতে পারে।
জুলাইয়ের বিপ্লবের পর জাতি হিসেবে আমরা সত্যিই একটি অনন্য সাংবিধানিক মুহূর্তে উপনীত হয়েছি। কারণ, এই বিপ্লব গণ–অভ্যুত্থান ১৯৭১–পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যান্য গণজাগরণ বা গণ–অভ্যুত্থান থেকে আলাদা। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে যেকোনো সমাজে তার সংবিধান তখনই কাজে আসবে, যখন সমাজের ভেতরকার সব শক্তি, বিভিন্ন অংশীজন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সংবিধানকে মান্য করে। আর সেই কারণেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্যান্য রাজনৈতিক–সামাজিক শক্তিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রায়ণও নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে রাষ্ট্রের ক্ষমতার মালিকরূপে ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাসীনদের দাস বা ভৃত্যরূপে নয়।
* রিদওয়ানুল হক: মেলবোর্নের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী ডিন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক