বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কার কীভাবে সম্ভব

ভবিষ্যতের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে কিছু পূর্বশর্ত মেনে এর সংস্কার প্রয়োজনছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অতীতের মতো আবারও এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কাজটা অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে সম্পন্ন করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সমাজের সর্বস্তরে যে আলাপ চলছে, সেখানে শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির আছে। আলাপ উঠেছে শিক্ষা সংস্কারেরও।

যা কিছু শিক্ষার দৈনন্দিন রুটিন তৎপরতার বিষয়, সেটাই শিক্ষা সংস্কার নয়। কারণ, যেকোনো খাতের রুটিন কাজ ও তৎপরতার সংকট বা সীমাবদ্ধতাগুলো একটা যোগ্য, দক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনাকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব নয় সেই খাতের নিজস্ব সংগঠন ও ধারণাগত জায়গাগুলোতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ। আর এটা করা না গেলে শিক্ষা খাতের সংস্কার একেবারেই সম্ভব নয়। বিশেষভাবে আরও যেটা বলতে হবে, বাংলাদেশের জন্য এটা একেবারেই সম্ভব নয়।

এর জন্য প্রথমেই যেটা মনে রাখতে হবে তা হলো, বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা আজ অতি মুমূর্ষু। মুমূর্ষকে নিয়ে প্রথমেই কোনো উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখা যায় না। তাকে প্রথমে দ্রুততার সঙ্গে রোগ নির্ণয় করে সঠিক দাওয়াই দিতে হয়। এ কাজটি সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে করতে পারার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের শিক্ষার ঘুরে দাঁড়ানো অথবা মৃত্যুর দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া। তাই শিক্ষা নিয়ে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল বা সংগঠনের যে ভাবনাই থাক কিংবা সামষ্টিকভাবে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমে এই দিকটি ভাবতে হবে।

দ্বিতীয় হলো, যেকোনো খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের জন্য অন্তত চারটা ধাপে ভাবতে হয়—জরুরি, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। খাতের চরিত্র ও পতনের দশা বুঝে কোন কাজটা কোন ধাপে করা হবে, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, চিহ্নিত কাজ বা পদক্ষেপগুলোর আন্তসম্পর্কের মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয় করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতার সঙ্গে সেই খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। সুতরাং বাংলাদেশের শিক্ষাকে এই পতিত দশা থেকে উদ্ধার করতে হলে সবাইকে উদ্ধার তৎপরতার এসব ধাপ ও সেগুলোর আন্তসম্পর্ক বুঝতে হবে এবং তার ভিত্তিতে কথা বলতে হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষার সব ধারা-উপধারার একত্রীকরণের সুবিধার একটা ইউটোপিয়া নানা সময়ে হাজির করা হয় এবং এর পক্ষে অনেক যুক্তিতত্ত্বও দেওয়া হয়।

তৃতীয় হলো, বাংলাদেশের শিক্ষায় অনেক ধারার কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের শিক্ষায় মোটাদাগে দুটি ধারা আছে। একটি সাধারণ ধারা এবং আরেকটি মাদ্রাসাধারা। মোটাদাগেই বলা যায়, সাধারণ ধারা রাষ্ট্র পরিচালিত এবং মাদ্রাসা ধারা সমাজ পরিচালিত। সাধারণ ধারার মধ্যে আবার চারটি বড় উপধারা আছে। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন ও আলিয়া। অন্যদিকে সমাজ পরিচালিত মাদ্রাসা ধারার মধ্যেও বেশ কিছু উপধারা আছে। যেটা উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসব ধারা ও উপধারা মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ দেশে তিন কোটি মানুষও নেই। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে যেকোনো ভাবনা বা পরিকল্পনা শুধু নিজের গোত্র, বিশ্বাস, একটা স্কুল, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ অভিজ্ঞতার নিরিখে নয়, এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এবং তাদের ধারা-উপধারার কথা মনে রেখে ভাবতে পারতে হবে।

চতুর্থ হলো, যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের শিক্ষায় এসব ধারার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে তাকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে রেখে শিক্ষার উন্নয়নের কথা ভাবা যায়, আবার তাদের একত্র করেও ভাবা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষার সব ধারা-উপধারার একত্রীকরণের সুবিধার একটা ইউটোপিয়া নানা সময়ে হাজির করা হয় এবং এর পক্ষে অনেক যুক্তিতত্ত্বও দেওয়া হয়। এসব যুক্তিতত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে বিজ্ঞানের কথা বলা হয়, প্রগতি ও আধুনিকতার কথা বলা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিক্ষা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়। বস্তুত কোনো বিজ্ঞানই সমাজবিজ্ঞান নিরপেক্ষ নয়, সাপেক্ষ। বাংলাদেশের শিক্ষাকে বাঁচাতে হলে বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। পদ্মা-ভাগীরথী-গড়াই হয়ে যে প্রবাহ শত বছর ধরে ছুটে চলল, তাকে আবার উল্টো ঘুরিয়ে গঙ্গার অভিন্ন প্রবাহে মিশিয়ে দেওয়াই একমাত্র ভালো এবং সেই ভালো না করা পর্যন্ত আর কিছু ভালো করা যাবে না, এই মত যে সমাজবিজ্ঞানসম্মত নয়, তা সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

পঞ্চম হলো, বাংলাদেশে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার সংবিধানে ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার’ আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছিল। এর আক্ষরিক অর্থ বা প্রকৃত অর্থ নিয়ে বিতর্ক না করেও বলা যায়, সংবিধান গ্রহণের পর রাষ্ট্র কখনো এটা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এটা নিয়ে বিগত ৫৩ বছরে ব্যাপক কোনো গণ-আন্দোলন হয়েছে তেমনও নয়। তবে সাংবিধানিক এই অঙ্গীকারের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে নানা সংগঠনকে বিজ্ঞানভিত্তিক’ শব্দটা জুড়ে দিতে দেখা গেছে, ‘কর্মমুখী’ শব্দটাও নানা অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সংবিধানের অঙ্গীকার এবং তার সঙ্গে যুক্ত এসব পরিপূরক শব্দে শিক্ষার গুণগত কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও এগুলোর আপাত ও চূড়ান্তঘাতের শিকার যেসব ধারা বা উপধারা হয়েছে, তারা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ধারার প্রতিপক্ষ হিসেবেই মূলত সমাজে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় তারা ক্রমাগতভাবে নিজেদের সংকট আড়ালে রেখে অস্তিত্ব রক্ষার প্রতি সচেতন হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষার ক্রমনৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদেরকে বিকল্প হিসেবে ভাবতে শিখেছে। শিক্ষা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালিত এবং সমাজ পরিচালিত শিক্ষার নানা স্তরের মধ্যে বিরাজমান এই শিক্ষা-পরিস্থিতিটা জরুরিভাবে বুঝতে হবে।

রাখাল রাহা

ষষ্ঠ হলো, আমাদের মতো রাষ্ট্রের শিক্ষা-পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির বিচিত্র ইচ্ছা ও ইশারা থাকে। তাদের হয়ে এনজিও এবং আইএনজিও নামের নানা ধরনের উন্নয়ন-বাণিজ্যিক সংগঠন কাজ করে। দেশের সরকার সেগুলো মেনে নিয়েই চলে, কারণ এতেই তাদের ক্ষমতাস্বার্থ রক্ষিত হয় তুলনামূলকভাবে অধিক। শুধু তা–ই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বহুবিধ হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য তারা নিজেরাও শিক্ষা-পরিস্থিতির মধ্যে পরিকল্পিতভাবে হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের শিক্ষার সব ধারা-উপধারা, কমবেশি, এই হস্তক্ষেপের শিকার। সুতরাং সাদা চোখে আমরা শিক্ষার বিভিন্ন ধারাকে যা দেখি এবং দেখে তার বিষয়ে যেভাবে ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নিই, তা সব সময় সত্য নয়। শিক্ষার এই রাজনীতি না বুঝে শিক্ষা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

সপ্তম হলো, বাংলাদেশের শিক্ষার সব ধারা ও উপধারার মধ্যে সর্বাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে সাধারণ ধারার বাংলা মাধ্যমে। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাস হলো সাধারণ ধারার শিক্ষা ধ্বংসের ইতিহাস। আর এই ধ্বংসটা পরিকল্পিত। বস্তুত এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এসব ধ্বংস ও তার পরিকল্পনা যাতে আমরা বুঝতে না পারি, সে জন্য শত্রু হিসেবে শিক্ষার অন্যান্য ধারা, বিশেষ করে সমাজ পরিচালিত মাদ্রাসা ধারার দিকে নেতিবাচকভাবে তাকানোর সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে শিক্ষার সংকট ধারাভেদে পৃথক এবং সেগুলোর মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্যও রয়েছে। কিন্তু এ দিকটা উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিশেষ ধারা বা উপধারার ওপর বিশেষ বিদ্বেষ সৃষ্টির যে সংস্কৃতি, তা রাষ্ট্রনির্মিত। বাংলাদেশের শিক্ষায় যেকোনো ধরনের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করতে হলে এই সংস্কৃতিকে বুঝে ও মোকাবিলা করে এগোতে হবে।

অষ্টম হলো, শিক্ষা অবস্তুগত সম্পদ। বস্তুগত সম্পদের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এটার ভালো-মন্দ বা বড়-ছোট বিবেচনার মাপকাঠি সুনির্দিষ্ট নয়। তাই সমাজে বস্তুগত সম্পদের ভালো-মন্দ নিয়ে যত সহজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, অবস্তুগত সম্পদ নিয়ে তা নয়। বস্তুগত সম্পদের কর্তৃত্ব বা মালিকানা বা রক্ষার তাগিদ নিয়ে সমাজে যত আগ্রহ থাকে, অবস্তুগত সম্পদ নিয়ে তা থাকে না। বস্তুত একটা সমাজ কতখানি এগিয়ে তা বোঝা যায়, সেই সমাজে অবস্তুগত সম্পদের গুরুত্ব কতখানি বা এ বিষয়ে মানুষের বোঝাপড়া কেমন তার ধরন দেখে। সে বিচারে বাংলাদেশ একটা পশ্চাৎপদ দেশ। এই পশ্চাৎপদতার কারণ যেটাই হোক, সম্পদ হিসেবে শিক্ষার এই বৈশিষ্ট্য না বুঝে, সে বিষয়ে সমাজের মানুষের ভাবনার স্তর না ভেবে করণীয় করা ঝুঁকিপূর্ণ। 

নবম হলো, অবস্তুগত সম্পদ ‘শিক্ষা’ প্রাপ্তির উপায় হিসেবে অধিকাংশ মানুষ আবার বস্তুগত উপকরণ, অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তককেই বোঝে। সে কারণে মানুষের এই বোঝার জায়গাকে ঘিরেই শিক্ষার দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা কষে অধিক। সমাজে চিন্তার বিভাজনকে ব্যবহার করে তারা পাঠ্যপুস্তকে এমন সব পাঠ বা ধারণার এমনভাবে সমাগম ঘটায়, যা সেই বিভাজনকেই আরও তীব্রভাবে উসকে দেয়। সেই উসকানিতে তখন শিক্ষার মানে হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা বিশেষ কোনো পাঠ থাকা বা না-থাকার মতো বিষয়। বস্তুত কোন পাঠ কোন বিষয়ে কেন পাঠ্য হবে, সেই পাঠে কী কী শিখন-উদ্দেশ্য হাসিল হবে, কীভাবে হবে? এই বোধের জায়গায় তখন পৌঁছানো সম্ভব হয় না। শিক্ষার ভাবনায় পাঠ্যপুস্তকের এই রাজনীতি না বুঝে এগোনো সম্ভব নয়।

সব ধারার শিক্ষাকে তার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেই মানসম্মত হতে হবে, সেখানের শিক্ষার্থীর জীবন নিরাপদ ও শিক্ষার পরিবেশ অনকূল হতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

দশম হলো, শিক্ষা একটা ইতিবাচক প্রপঞ্চ। শুধু ইতিবাচক নয়, এটা হলো মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইতিবাচক প্রপঞ্চ। অতীতে মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রপঞ্চ থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার মাধ্যমে ধ্বংসসাধনের পরিকল্পনা করা হতো। বর্তমানে এটাকে সবার জন্য সুযোগ হিসেবে হাজির রাখার মাধ্যমে ধ্বংসের পরিকল্পনা সাজানো হয়। সবার জন্য যেনতেন কোনো এক ধরনের শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে যদি তার উপযোগী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না করা হয় কিংবা যদি পরিকল্পিতভাবে উল্টোটা করে তোলা যায়, তবে পূর্বের অশিক্ষা থেকে সেই সমাজের যতখানি ক্ষতিসাধন করে স্বার্থ হাসিল করা যাচ্ছিল, পরের তথাকথিত শিক্ষা দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হয়, এবং একই সঙ্গে বহুগুণ বেশি স্বার্থসিদ্ধিও লাভ করা যায়। আগামীর বাংলাদেশে শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে হলে এই ইতিবাচক প্রপঞ্চের রাজনীতিটা বুঝে করতে হবে।

একাদশ হলো, শিক্ষায় রাজনীতি, শিক্ষার রাজনীতি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি—এগুলো পৃথক বিষয়। প্রতটি বিষয়কেই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা সম্ভব। শিক্ষায় রাজনীতি সহজেই ধরা যায়, আর শিক্ষার রাজনীতি ইতিবাচক প্রপঞ্চ নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালিত হয় বলে সহজে ধরা যায় না। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বিষয়টা এ দেশে সহজে ধরা যেমন যায়, তেমনি ঐতিহাসিকভাবে ইতিবাচকতার রাজনীতি দ্বারা গভীরভাবে আচ্ছন্ন থাকার কারণে এর নেতিবাচকতার মাত্রাকে সহজে উপেক্ষাও করা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিকতা কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের চাওয়া অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, আবার কখনো সংখ্যালঘিষ্ঠের না-চাওয়া অনুযায়ীও নির্ধারিত হয়; কখনো ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, আবার ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুযায়ী তা বাতিলও করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির চলমান ধারাকে এই নিরিখে বিচার করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

দ্বাদশ হলো, এ দেশের সব স্কুল-কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বা বেসরকারি, রাষ্ট্র পরিচালিত বা সমাজ পরিচালিত, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক—তার সবাই যে আমাদের এবং এখানে যারা পড়ছে তারা যে এ দেশেরই নাগরিক বা ভবিষ্যৎ নাগরিক এবং সে কারণেই যেসব ধারার শিক্ষাকে তার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেই মানসম্মত হতে হবে, সেখানের শিক্ষার্থীর জীবন নিরাপদ হতে হবে এবং শিক্ষার পরিবেশ অনকূল হতে হবে, এটা না বুঝে বা এই দাবিতে একমত না হয়ে এবং এই ধারাগুলোর প্রবাহ ও বিকাশের সুস্থ ধারাবাহিকতার প্রতি চরম অনাস্থা রেখে শুধু ইতিবাচকতার বোধ দিয়ে শিক্ষায় যা কিছু হস্তক্ষেপ করা হবে তাতে যে আরও কুফল ফলতে পারে, তা সবাইকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। 

পরিশেষে যেটা বলার, শিক্ষা সংস্কারের যত ভালো রূপরেখা বা কাঠামোই ভাবা হোক না কেন তা করা সম্ভব হবে না বা করলেও তা বাস্তবায়ন করে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না, যদি না এই পূর্বশর্তগুলোর বিষয়ে আমরা এখনই মনোযোগ দিতে এবং ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি।


* রাখাল রাহা : শিক্ষাবিষয়ক গবেষক