পুলিশের জনবান্ধব ভাবমূর্তির লক্ষ্যে

জনবান্ধব পুলিশ-বাহিনী গড়ে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরিছবি: প্রথম আলো

জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। অন্যান্য কমিশনের মতো তিন মাসের মধ্যে এই কমিশনকেও সম্ভাব্য সংস্কারের সুপারিশমালা রিপোর্ট আকারে পেশ করতে হবে।

জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর জনবিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মনে অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ উপচে পড়েছে ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে। সরকার পতনের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের ২২৪টি স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ভাঙচুর করা হয়। বেশ কিছু থানায় এখনো পরিপূর্ণভাবে কাজে ফেরেনি অনেক পুলিশ। গত ২৫ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ৪৪ জন পুলিশ সদস্যের তালিকা প্রকাশ করেছে।

এসব ধারাবাহিকতায় নতুন প্রেক্ষাপটে কীভাবে পুলিশ বাহিনীর কার্য পরিচালনা আধুনিক ও জনবান্ধব করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সাধারণ জনগণ এই বিষয়ে তাদের অভিমত ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারছে, যা সহিংসতা–পরবর্তী সময়ে পুলিশের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ কমাতে সাহায্য করবে। পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের প্রশ্ন এলে প্রথমেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন। 

বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত হয় ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের মাধ্যমে, যা ১৮৬৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; পুলিশ প্রবিধানমালা বেঙ্গল, ১৯৮৩; পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) ১৯8৩ এবং অন্যান্য আইনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন করে থাকে। খেয়াল করার মতো বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি আইনই ব্রিটিশ আমলের, যা ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য রেখে তৈরি করা। তা যদি নাও হতো, এক-দেড় শ বছরের পুরোনো আইন কখনোই এই সময়ের জন্য কার্যকরভাবে প্রযোজ্য হতো না। বহু দিন ধরে এসব আইন আধুনিকায়ন ও পরিমার্জন করার আলোচনা হলেও কোনো সরকারই তার বাস্তব রূপ দেয়নি।

পুলিশকে সংস্কার করতে হলে শুধু পোশাক আর মনোগ্রাম পাল্টালে চলবে না, একই সঙ্গে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির মতো বিষয়গুলোকে বিরাজনীতিকরণ করতে হবে, আর এটাই হবে প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্টের (পিআরপি) অধীনে পুলিশ সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের কথা এ ক্ষেত্রে বলা যায়। এটি বছরের পর বছর কেবল খসড়া হিসেবেই সীমাবদ্ধ আছে। ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭’ নামের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের কিছু ধারায় পরিবর্তন এনে ২০১৩ সালে পুনরায় খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এই অধ্যাদেশে পুলিশ সদস্যের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো, পুলিশের জবাবদিহি বাড়ানোসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুগোপযোগী বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অপর দিকে, এই অধ্যাদেশে, সরল বিশ্বাসে কর্তব্য সম্পাদনের কারণে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা দণ্ডিত হবেন না এবং তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, এ ধরনের ধারাও সংযোজিত হয়েছে। দায়মোচনসহ এই অধ্যাদেশে স্বাধীনতার নামে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় বলে জানা যায়। নানাবিধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে অধ্যাদেশটি আর আলোর মুখ দেখেনি। খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশের জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাদ দিয়ে জনমুখী ও জবাবদিহি বিষয়ের ধারাগুলো বর্তমান সংস্কার কমিশন বিবেচনায় নিতে পারে।

তবে মোটাদাগে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রধান দুটি সমালোচনার একটি হলো, সরকারি দলের ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে পুলিশ বাহিনীর কাজ করা ও জনবিমুখ একটি ভাবমূর্তির মধ্য থেকে জনগণের জন্য কাজ করার অকার্যকর চেষ্টা করা। বিপদে পড়লে একজন সাধারণ মানুষ প্রথমেই পুলিশ বাহিনীর সাহায্য চাওয়া বা থানায় যাওয়ার কথা ভাবতে ভয় পায়, বিশেষ করে তাদের অভিযোগ যদি অপেক্ষাকৃত বিত্তবান বা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়।

সরকারি দলের প্রভাব থেকে পুলিশ বাহিনীকে মুক্ত করতে হলে, প্রাথমিকভাবে পুলিশের জন্য ভিন্ন একটা বিশেষ কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গেছে। কমিশনকে অবশ্যই রাজনৈতিক ও দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে এর একটি শক্তিশালী কাঠামো গঠনের প্রয়োজন, যেন চাইলেই সরকার এর কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। ফলে পুলিশকে সংস্কার করতে হলে শুধু পোশাক আর মনোগ্রাম পাল্টালে চলবে না, একই সঙ্গে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির মতো বিষয়গুলোকে বিরাজনীতিকরণ করতে হবে, আর এটাই হবে প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা পুলিশ বাহিনীর ওপর সরকারি দলের প্রভাব এমনি এক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে পরিবর্তন করতে হবে। 

উম্মে ওয়ারা

এ ছাড়াও জনবিমুখ ভাবমূর্তি থেকে জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হতে প্রথমেই ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হওয়ার মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের আচরণবিধির মানোন্নয়ন জরুরি যেন সাধারণ জনগণের সঙ্গে সৌজন্য ও সম্মানের সঙ্গে তাঁরা দায়িত্ব পালন করেন। নারীসহ আর্থসামাজিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তিদের নিরাপত্তাবোধ এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে জনবান্ধব একটি বাহিনী হিসেবে পুলিশ বাহিনীও রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। জনবান্ধব বাহিনী হওয়ার জন্য যাবতীয় বেআইনি কাজের জন্য পুলিশ বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথক কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদে তা পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়তে সহায়তা করবে।

এসব দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পাশাপাশি এই মুহূর্তে স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নেওয়াও প্রয়োজন। বর্তমান পুলিশবিরোধী মনোভাবের কারণে অনেক থানা পুরোদমে কাজ শুরু করেনি, যার ফলে গত দুই মাসে ফৌজদারি মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরিসংখ্যান নিম্নমুখী। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা থানায় পর্যাপ্ত সেবা পাচ্ছেন না। চলমান বাস্তবতায় পুলিশ বাহিনীর সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে তাদের মনোবল ফেরানো ও হতাহত পুলিশদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তাদানের বিষয়টি বর্তমান সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে। 

শেষ করার আগে এ কথা বলাও প্রয়োজন যে আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীর সমালোচনা যতটা করা হয়, প্রশংসা সেভাবে করা হয় না। কারণ আমরা প্রত্যাশা করি, জনগণের সেবা করাই পুলিশের প্রধান কাজ, কিন্তু পুলিশের চাকরি কতটা চাপের, তা নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। পুলিশ উপসংস্কৃতির (সাবকালচার) স্বতন্ত্র নানামুখী চাপ, উদ্বেগ, বিপদ ও বিচ্ছিন্নতা একজন শক্তিশালী মানসিক গঠনের মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারে, যা নিয়ে আমরা একদমই ভাবি না। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী মহল, রাষ্ট্র সবাই আমরা একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী চাই। কিন্তু পুলিশের মনের যত্ন না নিয়ে একটি ‘আধুনিক পুলিশ বাহিনী’ নির্মাণ করা আদৌ সম্ভব কি না, তা–ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এ কারণে সাংগঠনিকভাবেই পুলিশ বাহিনীতে প্রফেশনাল মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেন্টার সহজ প্রাপ্য করা দরকার এবং অন্যান্য সংস্কারের পাশাপাশি মানসিক সাহায্য নেওয়ার বিষয়টাকে উৎসাহিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। 


* উম্মে ওয়ারা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক; যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের পিএইচডি গবেষক