কর্মসংস্থান প্রশ্নের বাস্তব হালনাগাদ

চাকরিক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কোটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিলছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশে আমরা এমন একটা সময়ে ও বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ বিবেচনা করছি, যেখানে আমাদের কিছু অনিবার্য প্রশ্ন করতেই হবে। কারণ, অনেকের কাছেই এখন কর্মসংস্থান প্রশ্ন ধাঁধা আকারে হাজির হয়েছে। বিগত দেড় দশকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের অর্থনীতিকেন্দ্রিক যেসব তথাকথিত মহাবয়ান—যেমন প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, রপ্তানি আয়, ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের প্রযুক্তি-নিবিড় শিক্ষা ইত্যাদির মধ্যে আদতে কর্মসংস্থান প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়েছে কি না। যাবতীয় সামষ্টিক মহাবয়ানের মধ্যে থেকে আমরা কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী ও দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহযোগ্য করতে পেরেছি? সে ক্ষেত্রে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের তোড়জোড়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার গুঞ্জন কি কেবলই রাজনৈতিক ভোজবাজি ও বৈধতা উৎপাদনের উপাদান ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের দরকার ওই মহাবয়ানগুলোর রাজনৈতিক অর্থনীতি তালাশ করা। এ জন্য এই রচনাকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাই করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের পুরো ক্ষেত্র অনেক বেশি সংকুচিত। কয়েকটা প্রচলিত খাতের মধ্যেই সব চাকরি সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে আবার সিংহভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক। যেমন তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থানের বড় কয়েকটি খাত হচ্ছে সরকারি চাকরি, কৃষি, সেবা, ভোগ্যদ্রব্য উৎপাদন, তৈরি পোশাক, অভিবাসন, মজুরিভিত্তিক শ্রম ইত্যাদি। কিন্তু এ ছাড়া বেশ কিছু সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে, যেখানে শ্রমপ্রবাহ পর্যাপ্ত নয়। উল্লেখ্য, যে বৃহৎ জনশক্তি প্রচলিত খাতগুলোয় নিয়োজিত, ব্যতিক্রম বাদ দিলে সে খাতগুলোও দক্ষতানির্ভর নয়। ফলে দেশের বিপুল জনশক্তি অদক্ষ থেকে গেছে। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের খাতগুলোয় বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে বিস্তৃত করা এবং সেগুলোয় শ্রমপ্রবাহ ত্বরান্বিত করা সম্ভব না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু পরস্পর আন্তসম্পর্কিত কারণ রয়েছে। মোটাদাগে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাব, খাতে বিদ্যমান অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রতিকূল ব্যবসায় পরিমণ্ডল, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা বিকাশের অভাব, অদক্ষ শ্রমপ্রবাহ, সরকারি চাকরির প্রতি অস্বাভাবিক ঝোঁক ইত্যাদি। প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত মান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপস্থিতি ইত্যাদি রাজনৈতিক পূর্বশর্ত ছাড়াও বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক কাঠামো, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের নির্ভরযোগ্যতা, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, প্রতিকূল ব্যবসায় পরিমণ্ডল অন্যতম অন্তরায়। পাশাপাশি অদক্ষ শ্রমপ্রবাহও বিনিয়োগকারীদের বহুলাংশে নিরুৎসাহিত করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাস্তবিক প্রতিবন্ধকতার প্রায় সব শর্তই আমাদের বেলায় খাটে। তবে অর্থনীতির আওতার বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থানের সমস্যা ও চাকরিপ্রার্থী তরুণ জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার দর্শনের মৌলিক ও নীতিগত গলদের পটভূমি আরও তলিয়ে দেখা দরকার।

প্রথমত, বাংলাদেশে সরকারি চাকরির জন্য এমন অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা কেন? কারণ, আমরা কর্মসংস্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সচ্ছলতা ও আত্মমর্যাদার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমরা পেশাগত পর্যায় দিয়ে নাগরিকের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করতে অভ্যস্ত। নিশ্চয়তা, ক্ষমতা–লাগোয়া অবস্থান ও ক্ষমতাচর্চার ব্যাপ্তি, সামাজিক অবস্থান, সরকারি বিশেষ সেবাগুলোয় অবাধ সুযোগ, পেনশন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের জন্য সরকারি চাকরি সবার কাছে আরাধ্য।

অন্যদিকে এর জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে আমাদের ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফ্যাসিবাদী রেজিমে আমরা দেখি, বাধ্যতামূলক গণরুমে বসবাস, গেস্টরুমে নির্যাতন ও জোর করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ফলে একজন শিক্ষার্থী অনার্সের ন্যূনতম দুই বছর সময় লার্নিং লসের শিকার হয়, যার প্রভাব পড়ে তার রেজাল্টের ওপর। উপরন্তু আবাসিক হলে নিপীড়নমূলক পরিবেশে থাকার ফলে মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, বেসরকারি চাকরির খাত সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্যের ফলে সুযোগের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয় এবং বেসরকারি কর্মসংস্থানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে না।

ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান প্রশ্নে তাৎপর্যগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দক্ষ, কার্যকর, উৎপাদনমুখী শ্রমশক্তির অভাব। এর জন্য দায়ী প্রধানত আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যকার অসামাঞ্জস্য। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের মাধ্যমে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের জরুরি শর্তাবলি বাস্তবায়নের জন্য এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের উপযোগী মানবসম্পদ গড়ার জন্য আমাদের যে ধরনের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও সে অনুযায়ী শিক্ষা অবকাঠামো ঢেলে সাজানোর দরকার ছিল, আমরা তা করতে মোটাদাগে ব্যর্থ হয়েছি। গুণগত মানের জায়গা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন ও অঞ্চলভেদে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের অধিকাংশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক উত্তরণের এ পর্যায়ে যখন দক্ষতানির্ভর উৎপাদন ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর করেছে, কারিগরি শিক্ষাকাঠামোকে সুসংহত করেছে যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ সেখানে জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে চাকরির বাজারে অনুপযোগী গ্র্যাজুয়েট উৎপাদন করে গেছে। উপরন্তু জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন জেলা পর্যায়ের কলেজগুলোর ব্যাপারে কী নীতি হবে, সেখানেও সংকট দেখা দিয়েছে।

দেশের শিক্ষার্থীদের বৃহত্তম অংশ এই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোয় পড়া সত্ত্বেও যথাযথ নীতি–নির্দেশনা, প্রায়োগিক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের অভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বেকার উৎপাদন কারখানায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উপার্জনক্ষম পাঠ্যবিষয়গুলোয় মানবসম্পদের প্রবাহ কম। কারণ, এসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য দরকারি নীতি বা অবকাঠামো অপর্যাপ্ত। জরুরি সুবিধাদি ও প্রণোদনা এখানে অনুপস্থিত। ল্যাবের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি সেকেলে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বিগত বছরগুলোয় ক্রমাগতভাবে অপ্রতুল ছিল। আমাদের এখানে কর্মসংস্থানের যে গোলকধাঁধা রয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যুগপৎভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে তার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন কর্মপদ্ধতি নিশ্চিত করা জরুরি। প্রকৃত অর্থে জনস্বার্থ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সামনে রেখে বাণিজ্যনীতি, কর্মসংস্থাননীতি, ব্যাংকিং ও আর্থিক নীতিমালায় সংস্কার আনতে হবে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমানে স্বল্প মেয়াদে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করতে হবে, যাতে দেশি ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারি। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সক্রিয় করতে হবে, উৎপাদনমুখী অবকাঠামোর মাধ্যমে মাঝারি থেকে ভারী শিল্পের দিকে ধাবিত হতে হবে কর্মসংস্থানের জন্য। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে ব্যবসায়ের পরিবেশ আরও অনুকূল করে তুলতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার বিকাশের জন্য আমাদের যথাযথ নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার, ঋণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রণোদনা থাকা উচিত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরকেন্দ্রিক। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগও এসব শহরেই কেন্দ্রীভূত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিটি ভৌগোলিক অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানে কর্মসংস্থানের ধরন ও উৎপাদিত পণ্যও একেক রকম। আমাদের অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা থাকা দরকার, যার মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে এবং শিল্পাঞ্চলগুলোর বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হবে। উদ্ভাবনী আইডিয়া, ব্যবসা উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মনোভাব তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে; তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রণোদনা ও দক্ষতা বৃদ্ধি প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোর বাস্তব অবস্থা জানার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ডেটা সংগ্রহ করা দরকার। জাতীয় বাজেটে ব্যাপক হারে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। কারিগরি, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য দরকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স এবং একাডেমিয়ার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয়। এ কথা এড়ানোর জো নেই যে আমরা একটা সংকটকাল অতিক্রম করছি, তবে সরকারের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করবে বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের গতিপ্রকৃতি।

* ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান: ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের (দায়রা) গবেষক