রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
শামসুর রাহমান: কবিতায় তাঁর জাতির ইতিহাস
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
সবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে। এর মাস দেড়েকের মধ্যেই, ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি, কলকাতার পার্ল রোড থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এক কবিকে চিঠি লিখলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। সে চিঠিতে ঝরে পড়ছে যুদ্ধের শূন্যতা ও বেদনা নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতার অকুণ্ঠ প্রশংসা। তিনি লিখলেন, ‘“এখানে দরজা ছিলো” অসাধারণ সুন্দর কবিতা। বহুদিন এমন মর্মগ্রাহী কবিতা পড়িনি। খাঁটি কবিতা, অথচ বাণীময় অর্থঘন…। সেটি এবং “স্যামসন” দেশ পত্রিকায় প্রকাশার্থে পাঠিয়েছি, দু’এক সপ্তাহের মধ্যে ছাপা হবে আশা করি। আপনার বই এতো তাড়াতাড়ি প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে আমরাও দুঃখিত হয়েছি, কারণ কোনো সন্দেহ নেই যে, পরে পাঠানো কবিতাগুলি অন্তর্ভুক্ত হলে সংগ্রহটি আরো অনেক সমৃদ্ধ হতো।’
কলকাতার সুধীমহলে আইয়ুবের অবস্থান তখন মধ্যগগনে। বাংলা সাহিত্যের অবাঙালি এই রসগ্রাহী পরিচয় পত্রিকায় প্রথমবার বাংলায় লিখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চমকে দিয়েছিলেন। সেটা ১৯৩৪ সালের কথা। এর মধ্যে তাঁর আরও তীক্ষ্ণ কিছু লেখা বেরিয়ে গেছে। চিঠিটি লেখার তিন বছর আগে বেরিয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিয়ে আধুনিক কবিদের সঙ্গে তাঁর ঝাঁঝালো তর্কের বই আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ। যে কবিকে তিনি লিখছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা তাঁকে চিনেছেন মজলুম আদিব নামে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় এই কবি ছিলেন অন্য কোটি বাঙালির মতো নিজ দেশে অন্তরীণ। কিন্তু তাঁর কবিতা পেয়ে গিয়েছিল অন্তরীণতা থেকে মুক্তির এক পথ। তিনি দুহাত ভরে লিখছিলেন, আর তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় সেসব লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন অবরুদ্ধ দেশের সীমান্তের ওপারে।
যুদ্ধের তছনছ হয়ে যাওয়া সেসব দিনে ওই কবিতাগুলোই পৌঁছে যাচ্ছিল আইয়ুবের হাতে, নানা হাত ঘুরে। আর তিনি করছিলেন পত্রপত্রিকায় কবিতাগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা। দেশের ভেতরে কবির ওপর না আবার কোনো বিপদ নেমে আসে, আইয়ুব তাই একটি ছদ্মনাম দিয়েছিলেন কবির—মজলুম আদিব, যার মানে নিপীড়িত লেখক। এই ছদ্মনামের আড়ালে যাঁর হাত দিয়ে যুদ্ধদিনে বাঙালির মুক্তির আবেগ ভাষা পাচ্ছিল, তিনি শামসুর রাহমান।
শামসুর রাহমানের সেসব কবিতার শেষ দুটি গুচ্ছ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রায় পর পর—মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে—১৮ ও ২৫ ডিসেম্বর। আইয়ুব চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনার চারটি কবিতা পড়ে অনেক পাঠক আপনার আশু প্রকাশিতব্য কবিতাগুচ্ছের জন্য বেশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন, প্রকাশক তাই বইখানা এতো তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে ফেলেন।’ বইটি প্রকাশিত হয় পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে, বন্দী শিবির থেকে নামে। বইটিতে খচিত হয়ে থাকে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি।
১৯৫২ সালের যে ভাষা আন্দোলনে পূর্বাঞ্চলের বাঙালি নিজের পথ খুঁজতে শুরু করল, কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের আবির্ভাবও সেখান থেকেই। এরপর থেকে যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাদেশের ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী মূলধারা রচনা করেছেন, তার প্রতি সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছে তাঁর কবিতা। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ঐতিহাসিক সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারীতে ‘আর যেন না দেখি’ শিরোনামে শামসুর রাহমানের যে কবিতাটি নিয়েছিলেন, তা কিন্তু লেখা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের বেশ আগে। হাসান কবিতাটি নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল একুশের বিস্ফোরণের আগেই তার উৎকণ্ঠা, গৌরব আর পূর্বসংকেত এ কবিতায় দানা বেঁধেছিল।
তবে শামসুর রাহমানের কবিতা তখনো ইতিহাসের রাজপথে এসে দাঁড়ায়নি। তাঁর শুরুর দিকের জনপ্রিয় কবিতা ‘রুপালি স্নান’-এ তিনি জানিয়েছিলেন, ‘শুধু দু টুকরো শুকনো রুটি’র বাসনা যেমন তাঁর নেই; আবার ‘শুধুই পৃথিবীর বহু জলে রেখা এঁকে’, ‘গোধূলির রঙে একদিন’, ‘ঘাসের শয্যা’ নিতেও তিনি ইচ্ছুক নন। তাঁর এই একাকিত্ব চূর্ণ করে দেয় আন্দোলনে আন্দোলনে উত্তাল ১৯৬০-এর তুমুল দশক। সে সময়ের তপ্ত রাজনৈতিক পটভূমিকায় কবি হিসেবে তাঁর আমূল রূপান্তর ঘটে। শামসুর রাহমানের কবিতা এর পর থেকে এক নতুন ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ–পূর্বের কম্পমান আবেগে রচিত ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা তাঁর এই পরিবর্তনের এক চিহ্ন।
বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের আবেগের সঙ্গে যেন প্রায় পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতা। ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী নির্মিতির আবেগ ও স্বপ্ন সবচেয়ে নিপুণভাবে উপচে পড়েছে তাঁর কবিতায়। বলা হয়ে থাকে যে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরটি কোনো কারণে লুপ্ত হয়ে গেলেও জেমস জয়েসের ডাবলিনার্স বইটি থেকে আবার সেটি গড়ে তোলা সম্ভব। একই কথা অন্যভাবে শামসুর রাহমানের কবিতার বেলায়ও খাটে। তাঁর কবিতা থেকে রচনা করে তোলা সম্ভব আমাদের জাতীয়তাবাদী ও উদার গণতান্ত্রিক মনোবাসনার ইতিহাসের এক যথাযথ পরম্পরা।
স্বাধীনতার পরও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সোচ্চার আন্দোলনে শামসুর রাহমান তাঁর কবিতা সমর্পণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশ সমরতন্ত্রের বুটে চাপা পড়লে তিনি লিখেছিলেন ‘ইলেকট্রার গান’; পেট্রোডলারের আশকারায় ধর্মীয় রাজনীতির মেরুকরণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যু হলে লিখলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। তাঁর কবিতা লিফলেট হয়ে মানুষের হাতে হাতে ফিরেছে; বহু পঙ্ক্তি রাতারাতি পেয়েছে প্রবচনের লোকপ্রিয়তা; উঠে এসেছে পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে, দেয়াললিখনে।
শুধু কবিতায় নয়, মানুষ হিসেবেও লিপ্ত হতে হয়েছিল শামসুর রাহমানকে। ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের একদলীয় স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার ঘোর নিদানকালে এক গরীয়ান দৃঢ়তায় যাঁরা এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সেই মুষ্টিমেয়দের একজন। এরশাদ সরকারের সময় তাঁর লাঞ্ছনা চূড়া স্পর্শ করেছিল। শামসুর রাহমানের একের পর এক ঝাঁঝালো কবিতায় ক্রুদ্ধ এরশাদ সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রিন্টার্স লাইন থেকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম মুছে দেন। দাপটের পাশাপাশি প্রলোভনও তাঁকে কম দেখানো হয়নি। কবির মুখেই শুনেছি, তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে প্যারিসে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদ জানিয়ে চাকরি ছেড়ে তিনি নেমে এসেছিলেন মিছিলে।
কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের ঐতিহাসিকতা অন্য আরেকটি ঘটনায় চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায় তরুণ এই কবি তাঁর ‘রুপালি স্নান’ কবিতাটি ছাপতে দিয়েছিলেন সংবাদ-এ। সাহিত্য সম্পাদক আবদুল গনি হাজারী ডেকে পাঠালেন তাঁকে। পত্রিকা অফিসে গিয়ে শামসুর রাহমান দেখতে পেলেন, কবিতার কিছু শব্দ লাল রঙে রেখাঙ্কিত। শব্দগুলো বদলে দিলেই কেবল তা ছাপা যেতে পারে। অসম্মতি জানিয়ে কবিতাটি নিয়ে চলে এসেছিলেন কবি।
ছোট এই ঘটনা ছিল বাংলা কবিতার নতুন একটি যুগেরও সূচনা। শামসুর রাহমানের সেই প্রত্যাখ্যান কেবল কোনো ব্যক্তিরুচির প্রতি ছিল না; ছিল বাংলা কবিতার এক ধরতাই রীতির প্রতি, অবরুদ্ধ এক মানসিকতার প্রতি, একটি পুরোনো যুগের প্রতি।
১৯৩০-এর দশকে বাংলা কবিতায় নতুনতর আধুনিকতার যে উপপ্লব ঘটেছিল, কবিতা তাতে ভাগ হয়ে পড়েছিল মোটাদাগে দুটি ধারায়। বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে এক দিকে রইল, যাকে বলা যেতে পারে, শুদ্ধতাপন্থী ধারা। এই বৃত্তের কবিতায় জায়গা করে নিল ব্যক্তির আবেগ। জনমানুষের বৃহত্তর জীবনের প্রতিধ্বনি সেখানে উঠল না। অন্য দিকে রইল প্রগতিশীল ধারা। মিছিলের ভাষার কাছে সেখানে কুণ্ঠিত হয়ে গেল একান্ত আবেগ। কবিতার এই কৃত্রিম বর্ণাশ্রম শামসুর রাহমান ভেঙে দিয়েছিলেন প্রায় যেন বিনা আয়াসেই। তিনি এমন এক অনায়াস নমনীয় ভাষা তৈরি করলেন, যার মধ্যে দুটি ধারাই আপসে পাশাপাশি ঠাঁই করে নিতে পারল। সেদিনের সেই ছোট্ট ঢাকা শহরের বুকে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির বুকে শামসুর রাহমানের হাতে অভিষেক ঘটল নতুন বাংলা কবিতার।
অনায়াস এই সহজ ভাষা তাঁর কবিতা অবাধও করে দিল সবার জন্য। শামসুর রাহমানের কবিতার বিরুদ্ধে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার অভিযোগ অন্তত কখনো ওঠেনি। তাঁর কবিতায় ঢুকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আবিষ্কার করল, এ কবিতা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার পরিধির বাইরের জিনিস নয়। শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে শামসুর রাহমান কবিতার এক পাঠকশ্রেণি জন্ম দিলেন। এর পরের ইতিহাস তাঁর বিজয় অভিযানের। তাঁর কবিতার ভাষা এরপর দশকের পর দশক বাংলাদেশের কবিতায় নিশান উড়িয়ে রাজত্ব করল। সেটিই হয়ে উঠল বাংলাদেশের একচ্ছত্র কাব্যভাষা। শামসুর রাহমান দেশের প্রধান কবি হিসেবে অভিষিক্ত হলেন।
তাঁর কবিতার সেই ছকে পা দিয়ে কোন কবি আনমনে চোরাবালিতে হড়কে পড়েননি? নবীন কোন কবি জীবনের প্রথম কবিতা লিখতে গিয়ে হাত মকশো করেননি তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার আদলের ওপর? এভাবেই শামসুর রাহমান ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের কবিতার এক প্রতিমূর্তি।
আর কোন কবির জীবনে এতটা ঘটেছে, এই বাংলাদেশে?
সাজ্জাদ শরিফ: কবি; নির্বাহী সম্পাদক, প্রথম আলো