সংবিধান সংস্কার কোন পথে কতটা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্র সংস্কার তথা সংবিধান সংস্কার ছাড়া যে এই সংকট থেকে বেরোনো যাবে না, এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত। তবে তর্ক দেখা দিয়েছে এ পরিবর্তনের মাত্রা ও পদ্ধতি নিয়ে। কেউ বলছেন, সংশোধন করতে হবে। কেউ চাইছেন সংস্কার। কারও আকাঙ্ক্ষা পুনর্লিখনের। আবার কেউ বলছেন, প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান।
প্রশ্নটি যেভাবে বুঝেছি
সংবিধান সংশোধনযোগ্য। দুই–তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য চাইলে নিয়ম মেনে সংবিধানের যেকোনো অংশই সংশোধন করা যায়। অন্যদিকে উচ্চ আদালত সংবিধানের রক্ষক। সংবিধানের কোনো সংশোধন সংবিধানসম্মত কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিলও করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশকে বলা যায় রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র বা আকাঙ্ক্ষা। বাকি অংশ, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষমতাকাঠামো। সংবিধান রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার বর্ণনা দিয়েছে তার মূলনীতি অধ্যায়ে (দ্বিতীয় ভাগ)। আবার সেগুলোকে আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলেও ঘোষণা করেছে ৮(২)। এতে মূলনীতি পরিণত হয়েছে কাগুজে প্রতিশ্রুতিতে এবং সরকারের ইচ্ছাধীন বিষয়ে। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্মিত ক্ষমতাকাঠামোর সবটুকুই মোটাদাগে মূলনীতির পরিপন্থী। মূলনীতি অধ্যায়ে লিখিত আকাঙ্ক্ষার বিপরীত কার্যক্রম পরিচালনার উপযোগী ও প্ররোচনাপূর্ণ। ফলে বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া নতুন রাষ্ট্র গঠন করা শুধু অসম্ভবই নয়; এই ক্ষমতাকাঠামো বহাল রেখে যত দিন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, তত দিন তা জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যেতে থাকবে।
এসব কারণেই আমরা সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো অংশটুকু বদলে জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ করার প্রস্তাব করেছি। এ পরিবর্তন ব্যাপক ও মৌলিক। একে সংশোধন বলা যাবে না। ‘সংশোধন’ শব্দের প্রচলিত সংজ্ঞার চেয়ে এ পরিবর্তন আলাদা ও ব্যাপক। তবে এই পরিবর্তন সংবিধানের সবকিছুই বদলে দেওয়া বা সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা নয়। তাই আমরা এই পরিবর্তনকে ‘সংবিধান সংস্কার’ বলছি। রাষ্ট্রের বিপ্লবী পরিবর্তনের পরিবর্তে বর্তমান সমাজবাস্তবতা বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্র সংস্কারের যে কর্মসূচি আমরা উত্থাপন করেছি, সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ক্ষমতাকাঠামোর ন্যূনতম কী কী পরিবর্তন করতে হবে
সংবিধানে ক্ষমতাকাঠামো শুরু হয়েছে চতুর্থ ভাগ থেকে। আমরা ক্ষমতাকাঠামো অংশ নিয়ে আলোচনাটি সংবিধানের ক্রমানুসারে না করে ভোগান্তির ক্রমানুসারে করতে পারি। যেমন আমাদের প্রথমেই সংস্কার করতে হবে নির্বাচনব্যবস্থা। এ জন্য ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার ব্যবস্থাটা সবার আগে বদলে দিতে হবে (১২৩.৩)। আইনসভা কিংবা সংসদে নির্বাচিতরা যাতে দলীয় প্রধানের অনুগত প্রতিনিধি না হয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে (৭০)। রাজনীতিকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে যাতে কেউ ব্যবহার করতে না পারে, তার জন্য সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নকে একমাত্র দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। আইন প্রণয়ন ছাড়া রাষ্ট্রের আর্থিক কোনো ক্ষেত্রে আর কোনো ভূমিকা রাখার ক্ষমতা তাদের দেওয়া যাবে না (৬৫)।
সংসদ যেসব আইন প্রণয়ন বা অনুমোদন করবে, সেসব আইন যাতে সংবিধানসম্মত হয় এবং সংবিধানসম্মত সেসব আইন যাতে যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়, তা দেখভালের দায়িত্ব আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সে জন্য উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা এবং বিচারকাজে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচার বিভাগের অধীনে আনার ব্যবস্থা করতে হবে (৯৫/১৩৩)। পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা পুলিশের হাতে রাখা যাবে না। বিদ্যমান ‘স্থানীয় শাসন’কে প্রকৃত স্থানীয় সরকারে রূপান্তরিত করতে হবে। জনগণের জন্য সেবামূলক এবং স্থানীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হবে (৫৯/৬০)। বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের লাগামহীন এবং একচ্ছত্র ক্ষমতাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের অধীন রেখে ক্ষমতার যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করা হয়েছে, তার পরিবর্তন করতে হবে ৪৮(৩)। নির্বাচন কমিশন, বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, মহাহিসাব নিরীক্ষক, কর্ম কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি নির্ধারণের জন্য ‘সরকারি দল-বিরোধী দল-বিচার বিভাগ’ সমন্বয়ে আলাদা কমিশন গঠন করতে হবে। লুটপাট ও পাচার বন্ধ করে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানমুখী প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের জন্য ব্যাংক-বিমা-বৈদেশিক বাণিজ্য-বাজেট-বৈদেশিক ঋণ তথা অর্থনৈতিক আইনকানুনের পরিবর্তন করতে হবে (৮১/৮২,৮৪-৯২)।
এ ছাড়া জনগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য মৌলিক অধিকারগুলোকে শর্তমুক্ত করতে হবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা—অন্তত এই পাঁচটি অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
ওপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনোটাই আদর্শিক বিষয় নয়। সংবিধানের এ অংশগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনে মোকাবিলা করার বিষয়। নাগরিকদের যারা যে মতবাদ, আদর্শ কিংবা যে ধারার রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত থাকুক বা না থাকুক, তারা প্রত্যেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যূনতম এই বিষয়গুলোর সমাধান চায়। তাই আমরা মনে করি, সংবিধানের এসব ফাংশনাল বিষয়ে সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো মতভিন্নতা তৈরি হবে না।
সংবিধান–বিতর্ক
সংবিধানের কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন, এ বিষয়ে আমরা ইতিহাসের বিতর্কমুখর তুমুল পর্ব পার হচ্ছি। মনে রাখা ভালো, মানুষ সেসব তর্কেই লিপ্ত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যে তর্ক তার পরিচিত এবং যে বিষয়ে তার নিজের একটা মত বা অবস্থান আছে।
আমাদের পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চ আদালত এবং রাজনৈতিক পরিসরে সংবিধান নিয়ে যতটুকু তর্ক হয়েছে, তার প্রধান অংশটা আদর্শ, ধর্ম বা নির্বাচনসংক্রান্ত। ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুবই সামান্য। সে জন্য জনপরিসরে এখনো সংবিধানের আদর্শিক দিক নিয়ে যত তর্ক এবং ভিন্নমত তৈরি হচ্ছে, ক্ষমতাকাঠামো নিয়ে ততটা আলোচনাই হচ্ছে না।
সংবিধান সংস্কার কোন পদ্ধতিতে
রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়োজন, এ প্রশ্নে সবাই একমত; কিন্তু সংবিধানের কতটুকু, কোন পথে পরিবর্তন করা যাবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। প্রচলিত শিক্ষা হলো জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সংবিধান ‘সংশোধন’ অথবা গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গঠন।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এমন একটি প্রয়োজনীয়তাকে সামনে এনেছে, যা প্রচলিত এই দুই ধারার কোনোটির সঙ্গেই জুতসইভাবে মেলে না। ফলে বিশেষ বাস্তবতায় যদি সংবিধান সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ এড়ানোর জন্য ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ বা ‘রিফর্ম অ্যাসেম্বলি’র নির্বাচন করা উত্তম হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনও একটা ধরন হতে পারে, যে নির্বাচনে নির্বাচিতদের প্রথমে সংবিধান সভা (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) হিসেবে এবং পরে সংসদ সদস্য (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) হিসেবে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল। নির্বাচনী বিধি বা ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’–এ সম্ভাব্য সংবিধানের মূলনীতি কী হবে, তার নির্দেশনাও দেওয়া ছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি। আমরা আন্দোলনকারী সব রাজনৈতিক দল-সংগঠন, অদলীয় সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধি, বিভিন্ন জাতি–গোষ্ঠী–লিঙ্গনির্বিশেষে সবার মতামত এবং বিশেষজ্ঞ মতামত সংগ্রহ করে সব মতামত থেকে ন্যূনতম ঐকমত্যের অংশটুকু বের করে এনে ‘সংস্কারের ঐকমত্যের রূপরেখা’ প্রণয়ন করতে পারি। সে রূপরেখা কোন পথে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে পথ নির্ণয় করে সংস্কারের পর্বটি সমাপ্ত করতে পারি।
আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে, সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হয় বৃহত্তর ঐক্য। আর নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যদের পরাজিত করা।
* হাসনাত কাইয়ূম: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক