নির্বাচনের জন্য কিছু জরুরি সংশোধনী
একাত্তরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। তবে সে নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসনের প্রথম ও অতি আবশ্যকীয় পদক্ষেপ হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
বাংলাদেশ ‘জেনুইন ইলেকশন’, অর্থাৎ সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। কারণ, রাষ্ট্র আকারে আমরা ‘সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’-এ স্বাক্ষরদাতা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বহুলাংশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আবার কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে। আর যখনই জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে, তখনই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনগুলোয় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বস্তুত নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এবং জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। ফলে দেশের সর্বস্তরে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। তাই এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
আশার কথা হলো, গত ৫ আগস্ট এক অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। স্বভাবতই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো নির্বাচনব্যবস্থাসহ দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন, যাতে দেশে আর কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসতে না পারে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার, বাক্স্বাধীনতা ও জবাবদিহির কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়।
আমরা আরও আশাবাদী, এ লক্ষ্যে সরকার বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার’ কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন পুরোদমে তার কাজও শুরু করেছে।
নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি যথাযথ আইনি কাঠামো সৃষ্টি, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধিবিধান। আরেকটি বিষয় হলো প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রক্রিয়া-পদ্ধতির সংস্কার। এসবের লক্ষ্য হলো একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন আয়োজন করে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
বাংলাদেশে নির্বাচনের আইনগত ভিত্তি হলো সংবিধান। তবে সাংবিধানিক নির্দেশনাকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু আইন ও বিধিবিধান রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু রায়, আদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করতে হলে সংবিধানে কিছু সংশোধনী আনা যেতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে প্রচলিত সহজ সংখ্যাধিক্য নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করা, জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচের বদলে চার বছর করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, জনসংখ্যার আধিক্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংসদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি অনুসরণ করে নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষণ ও সে আসনগুলোয় সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর বিপুল ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রাখা, আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণ, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও জনবলের অভাব ইত্যাদি কারণে নির্দলীয় সরকারের বিধান ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য হয়েছে। আশার কথা, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে ইতিমধ্যেই একটি রিট হয়েছে। একই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়েছে।
আরপিও সংসদ নির্বাচন–সম্পর্কিত মূল আইন। এই আইনে ৯টি অধ্যায় রয়েছে, যেগুলোর সঠিক প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য আরপিও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন এবং এর অস্পষ্টতা দূর করতে হবে।
গত ২৯ আগস্ট গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর পক্ষ থেকে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে কিছু করণীয় তুলে ধরা হয়েছিল। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। আমরা মনে করি, আরপিওসহ অন্যান্য নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধানে কিছু বিষয় যুক্ত করা দরকার। যেমন: ১. মনোনয়ন–বাণিজ্য অবসানের লক্ষ্যে প্রতিটি দলকে আসনভিত্তিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদান; ২. প্রার্থী হওয়ার শর্ত হিসেবে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ব্যক্তির কমপক্ষে তিন বছর আগে সংশ্লিষ্ট দলের সদস্যপদ গ্রহণের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা; ৩. ভোটারের অপছন্দের প্রার্থীদের বর্জনের জন্য ‘না’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন; ৪. দ্বৈত নাগরিকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না রাখার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা; ৫. প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় কমানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো, হলফনামার তথ্য প্রচার ও আসনভিত্তিকভাবে প্রার্থী পরিচিতি সভা আয়োজন করা; ৬. বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ও নির্বাচনী দায়িত্বে ব্যক্তিদের ভোটদানের ব্যবস্থা করা; ৭. বিরুদ্ধ হলফনামা প্রদানের বিধান আইনে সন্নিবেশ করা; ৮. সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের হলফনামা প্রদানে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; ৯. মনোনয়নপত্র ও হলফনামার ইলেকট্রনিক ফাইলিং বাধ্যতামূলক করা এবং হলফনামা ও আয়কর বিবরণী সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করার বিধান আইনে যুক্ত করা।
এ ছাড়া আরপিওর ৯০(খ) ধারায় বর্ণিত রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন না থাকার বিধানটি কার্যকর করা; ৯১(ক) ধারায় ‘ভোটে’র বদলে পুনরায় ‘নির্বাচন’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা; আরপিওর ৯২ ও ৯৩ ধারায় বর্ণিত দায়মুক্তির বিধান বাতিলের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া; সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
নির্বাচনী আচরণবিধিতে তিন জোটের রূপরেখার আদলে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো, প্রশাসনকে প্রভাবিত না করা, সরকারি প্রচারমাধ্যমের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নির্বাচনের দিন সব কারচুপি ও দুর্নীতির অবসান করা, নির্বাচনের মাধ্যমে প্রদত্ত গণরায় মেনে নেওয়া ইত্যাদি বিধান যুক্ত করা দরকার।
এ ছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নিরীক্ষণ ও জেন্ডার গ্যাপ নিরসন; জোটগত নির্বাচন হলেও প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে বাধ্য করা; নির্বাচন কমিশনের অধীনে এক তফসিলেই সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন আয়োজন; নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা সময়োপযোগী করা; গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য নীতিমালা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া দরকার।
রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ, আর্থিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আরপিওর ৯০ ধারায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে আরও কিছু বিষয় যুক্ত করা, হলফনামার বর্তমান ছক পরিবর্তন করা এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনকে যথাযথ করা; কমিশনারদের জন্য আচরণবিধিমালা প্রণয়ন করা; নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা; নির্বাচনী বিরোধ ছয় মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি করা এবং সীমানা নির্ধারণের জন্য গাইডিং প্রিন্সিপালস ও কিছু মানদণ্ড তৈরি করা।
আশা করি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যার মধ্যে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচ্ছন্ন হবে, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উত্তরণ ঘটবে।
* নেসার আমিন: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহযোগী সমন্বয়কারী