রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা
মাজহারুল ইসলাম: বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ
জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
১৯৫৩ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ঢাকার ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস (আর্ট কলেজ) ভবনের ডিজাইন করেন মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভবন হিসেবে এটিই স্বীকৃত। একই সময় ডিজাইন করা পাবলিক লাইব্রেরি (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) ভবনের স্থাপত্য সাফল্য এশিয়া মহাদেশে আধুনিকতার একজন অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে মাজহারুল ইসলামের অবস্থান নিশ্চিত করে। আর্ট কলেজের স্থাপত্য ডিজাইনে সত্যনিষ্ঠা ও দেশজ গভীর শিকড়বিদ্ধ প্রাসঙ্গিকতা আধুনিকতার এক অনন্য আঞ্চলিক ব্যাখ্যা ও নিদর্শন। সমকালীন পৃথিবীর নানা আধুনিক চাহিদা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে প্রণীত আর্ট কলেজের স্থাপত্যে নমনীয়তা, ভারহীনতা ও উন্মুক্ততা এবং লাইব্রেরি ভবনের স্থাপত্যে গাম্ভীর্য, অভিকর্ষ ও ভাসমানতা স্থপতি মাজহারের কর্মদক্ষতা ও সামর্থ্যই প্রমাণ করে।
১৯৫০ ও ৬০–এর দশকজুড়ে মাজহারুল ইসলামের সিক্স–বি পেনসিল ও কাঠকয়লা থেকে ফল্গুধারার মতো উৎসারিত হয়েছে ডিজাইন, নির্মিত হয়েছে একের পর এক আধুনিক স্থাপত্য। ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীপা ভবন, মতিঝিলে এডিসি ভবন ও জীবন বীমা ভবন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (রংপুর, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশাল) ইত্যাদি।
মাজহারুল ইসলাম আধুনিক স্থাপত্যচর্চাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি আধুনিক সমাজ নির্মাণে আজীবন সচেষ্ট ছিলেন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি বর্গফুট জায়গা ভৌত পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, রুচিশীল ও সভ্য দেশে পরিণত করা ছিল তাঁর স্বপ্ন। প্রথাগত সব ধ্যানধারণা ত্যাগ করে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ আধুনিক ও যুগোপযোগী স্থাপত্যের স্বরূপ নির্ণয়, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান সর্বাধিক। তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যের জনক ও স্থাপত্যগুরু। কলকাতা প্ল্যানিং ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সাবেক প্রধান স্থপতি ও খ্যাতিমান অধ্যাপক সন্তোষকুমার ঘোষ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্থপতি।’
সারা বিশ্বের বিশিষ্ট স্থপতি ও ইতিহাসবিদদের মূল্যায়নে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি নিয়ে যে বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র মাজহারুল ইসলামের চারটি কাজ স্থান পেয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ১০টি স্থাপত্যকর্ম সম্প্রতি প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছে ইউনেসকো।
১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণনগরের সুন্দরপুর গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন মাজহারুল ইসলাম। তাঁর বাবা ওমদাদুল ইসলাম ছিলেন কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে গণিতের অধ্যাপক। মাজহারুল ইসলাম কৃষ্ণনগর হাইস্কুল, রাজশাহী সরকারি হাইস্কুল ও রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়ালেখা করেন । তিনি ১৯৪০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৪২ সালে পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ বিএসসি করেন। স্কুলে পড়ার সময় কুমারপাড়ায় পোড়ামাটির কাজ দেখে অভিভূত হন বালক মাজহার। পরে রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে ভাস্কর্য ও রিলিফ কাজ দেখে মানুষের সৃষ্ট শিল্পকর্ম তাঁর অবচেতন মনে সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রতি এক গভীর উপলব্ধি সঞ্চার করে। মাজহারুল ইসলাম ১৯৪২ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৬ সালে পুরকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিবপুরে পড়ার সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁকে ক্রমে একজন আদর্শবান, সৎ ও আপসহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত করে, পরিণতিতে তিনি অর্জন করেন বহু শত্রু ও যৎসামান্য বন্ধু।
দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে মাজহারুল ইসলাম ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে যোগাযোগ, বিল্ডিং ও সেচ (সিবিঅ্যান্ডআই) মন্ত্রণালয়ে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে ‘পোস্টওয়ার ডেভেলপমেন্ট’ স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যায় পড়তে যান। সেখানে পুরকৌশলী থেকে ধীরে ধীরে একজন সৃষ্টিশীল স্থপতি হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর এই রূপান্তরে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন অধ্যাপক হেইডেন ও অধ্যাপক রস। ১৯৫৩ সালে
স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশের স্থাপত্য ও সভ্যতার ইতিহাস যে কম করেও তিন হাজার বছরের পুরোনো, এ কথা মাজহারুল ইসলাম জানতেন; কিন্তু প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণে তা আজ আহত, নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। তাঁর এই উপলব্ধি তাঁকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করে। দেশে ফিরে আসার পর সরকারের তৎকালীন প্রধান স্থপতি রেমন্ড ম্যাককনেল সহকারী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে আর্ট কলেজ ভবন ডিজাইন করার দায়িত্ব দেন। স্থপতি মাজহার কলেজ ভবনটির স্থাপত্য ডিজাইন ও সামগ্রিক পরিবেশ এমনভাবে বুনট করেন, যেন তা শিল্পকলার ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। আর্ট কলেজ ডিজাইন ও নির্মাণকালে (১৯৫৩–৫৬) স্থপতি মাজহারের সঙ্গে কলেজের শিক্ষকেরা, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া ও পরে রশীদ চৌধুরীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিল্পীদের প্রগতিশীল মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডের কারণে অচিরেই বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় আর্ট কলেজ। স্থপতি মাজহার তখন থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হয়ে পড়েন। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাধা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে তিনি অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বাম রাজনৈতিক দল ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতাসংগ্রাম ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
১৯৬৩ সালে প্রধান স্থপতি ম্যাককনেলের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুরকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে স্থাপত্য উপদেষ্টা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন স্থপতি মাজহার। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান। বাস্তুকলাবিদের ৩ নম্বর পরীবাগের অফিস থেকেই তিনি একাধারে স্থাপত্য ডিজাইন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রকল্পগুলো নিয়ে নেয় সরকার। বাধ্য হয়ে তিনি বাস্তুকলাবিদ বন্ধ করে দেন। তাঁর বয়স
তখন মাত্র ৪৮ বছর, যখন তিনি সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সৃজনশীল। চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুটির কাজ তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর এই কষ্ট সহজে বোঝার নয়। তিনি শুধু নীরব হয়ে থেকেছেন। স্থপতি মাজহার দুর্নীতির পথে পা বাড়াননি, ফলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ কর্মহীন।
১৯৫৯ সালে অ্যাবোটাবাদে অনুষ্ঠিত গভর্নরস কনফারেন্সে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনা প্রণয়নের অনুরোধ করেন কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী। কিন্তু তিনি নিজে এর পরিকল্পনা না করে পৃথিবী বিখ্যাত কোনো স্থপতিকে দিয়ে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পূর্তমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। বিশ্বখ্যাত তিনজন স্থপতির নামও প্রস্তাব করেন স্থপতি মাজহার। শেষ পর্যন্ত স্থপতি লুই আই কান রাজি হন। স্থপতি কান সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা করেন। সারা বিশ্বে সর্বকালের সেরা একটি স্থাপত্যকর্ম হিসেবে এখন সংসদ ভবন স্বীকৃত। কালোত্তীর্ণ এই ভবন কমপ্লেক্স বাংলাদেশের স্থপতিদের জন্য অন্তহীন প্রেরণার উৎস।
স্থপতি মাজহার বাংলাদেশে স্থাপত্যশিক্ষা ও পেশার উন্নয়নের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। তিনি ‘ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস পাকিস্তান’–এর সভাপতিও (১৯৬৮–৬৯) ছিলেন। এ ছাড়া নবীন ও উৎসাহী স্থপতিদের নিয়ে আশির দশকে ‘চেতনা’ নামের একটি পাঠচক্র গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ অনেকেই এই পাঠচক্রে সম্পৃক্ত হন। ১৯৮০–৮১ সময়ে সৌদি আরব সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মূল ভবনের ডিজাইন প্রতিযোগিতা ও আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের অন্যতম বিচারক ছিলেন মাজহারুল ইসলাম। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) স্থাপত্যশিক্ষা ও পেশায় বিশাল অবদানের জন্য তাঁকে ‘বাস্থই’–এর প্রথম স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে আধুনিক স্থাপত্য বিকাশে অবদান রাখার জন্য ১৯৮৯ সালে মাজহারুল ইসলামকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটউট অব আর্কিটেক্টস পশ্চিমবঙ্গ শাখা। ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে সম্মানীয় ফেলোশিপ প্রদান করে। এ বছর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস তাঁকে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে আধুনিক স্থাপত্য বিকাশে বিশেষ অবদানের জন্য গ্র্যান্ডমাস্টার্স অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। ১৯৯৯ সালেই বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
আদ্যপান্ত বাঙালি, মানবতাবাদী, রাজনীতিসচেতন, সংস্কৃতিমনস্ক স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসে তাঁর একনিষ্ঠ, সৃজনশীল ও মহৎ অবদানের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সামসুল ওয়ারেস: স্থপতি ও অধ্যাপক