রাষ্ট্র সংস্কার এবং রাষ্ট্রে ভিন্ন জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্তি
৫৩ বছর বয়সী একটা দেশে নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা জাতি ও সংস্কৃতির বহু মানুষের বসবাস। তবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে গোড়াপত্তনের পর থেকেই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের চৌহদ্দিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন মানুষের বিকাশ সুষমভাবে সম্পন্ন হয়নি। বাঙালি ছাড়া অন্য যে জাতিগুলো রয়েছে, তাদের জীবন ও যাপন খুব একটা সুবিধার মধ্যে নেই। তারা আদিবাসী, না ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, না উপজাতি, না সম্প্রদায়—তার সঠিক ফয়সালা রাষ্ট্র এখনো করতে পারেনি। এখনো পরিচয় নির্মাণের লড়াইয়েই ব্যস্ত আদিবাসী মানুষ। এর সঙ্গে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামও তাড়া করছে তাদের। প্রতিনিয়ত ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের আতঙ্ক, বাস্তুভূমি হারানোর যন্ত্রণা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা আর নানাভাবে পীড়নের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে তারা।
সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থান এ দেশের অধিকাংশ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ঠিক তেমনি আদিবাসী মানুষের মনের ভেতরও আশা জাগিয়েছিল এই অভ্যুত্থান। তারাও এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক বদলের ক্ষণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। কারণ, বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনও আদিবাসী মানুষের জীবনকে নিরাপত্তা দিতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী শাসনের মধ্যেই আদিবাসী মানুষকে ন্যক্কারজনক পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে বানানো হয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। যদিও ওই সংশোধনীতে জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায়, উপজাতিসহ নানা অভিধা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সরকারি নথিপত্রে প্রায়ই ব্যবহার করে হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দটি। অপমানজনক বলে আদিবাসীসহ এ দেশের প্রগতিশীল ও বোদ্ধা সমাজ এটি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
উত্তরবঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মানুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদের যন্ত্রণা। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনজন সাঁওতালকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে মারা যেতে হলো। আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখলাম রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে পুড়ছে দারিদ্র্যপীড়িত সাঁওতাল মানুষের খড়ে বানানো কুটির। তাদের হাতেই চোখ হারাতে হলো দ্বিজেন টুডুকে। দক্ষিণবঙ্গে সাতক্ষীরায় মুন্ডা জীবনের হাহাকার চোখে পড়ে। যে মুন্ডারা সুন্দরবনকে এত দিন আগলে রেখেছিল, সেখানকার জমিকে আবাদযোগ্য করেছিল, তারাই আজ সে অঞ্চলে নিজভূমে পরবাসী। ভূমিখেকোদের সঙ্গে বাস্তুভূমি রক্ষার লড়াই এবং লবণাক্ততার সঙ্গে নিয়ত জীবিকার সংগ্রাম। বরগুনা ও পটুয়াখালী অঞ্চলের রাখাইনদের অবস্থা আরও করুণ। ১৯৬০-এর দশকে যাঁদের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার, তাঁদের সংখ্যা এখন আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। আওয়ামী আমলের চটকদারি ‘উন্নয়নে’ ভেসে গেছে রাখাইনদের বহু পুরোনো জনপদ। পটুয়াখালীতে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনার ফলে রাখাইনদের ২০০ বছরের পুরোনো গ্রাম উচ্ছেদ করা হয়েছে। সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড দখলে ব্যস্ত রাখাইনদের বৌদ্ধমন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি। স্থানীয় ভূমিদস্যুরা বারবার রাখাইন আদিবাসীদের পবিত্র শ্মশান ভূমি পর্যন্ত দখলের চেষ্টায় রত। সিলেটের মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল অঞ্চলের খাসিয়ারা প্রতিনিয়ত পান জুম হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত। ভূমিখেকোদের ক্রমাগত আক্রমণ ও বিচারহীনতায় দেশান্তরি হচ্ছে তারা।
বাঙালি ছাড়া অন্য যে জাতিগুলো রয়েছে, তাদের জীবন ও যাপন খুব একটা সুবিধার মধ্যে নেই। তারা আদিবাসী, না ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, না উপজাতি, না সম্প্রদায়—তার সঠিক ফয়সালা রাষ্ট্র এখনো করতে পারেনি।
পাহাড়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, নিরাপত্তার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রীতিমতো অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পার্বত্য সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আদিবাসী মানুষের জীবন বদলের যে প্রতিশ্রুতি এ রাষ্ট্র করেছিল, তা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে প্রতারণার জালে। তিন জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে আদিবাসী মানুষের কার্যকর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা থাকলেও ২৭ বছর পেরিয়ে এর কোনো প্রতিফলন আমাদের চোখে পড়ছে না। বরং একধরনের কৃত্রিম সংঘাত জিইয়ে রেখেছে এই রাষ্ট্র।
শত হতাশা, সংকট আর হাহাকারের মধ্যে আদিবাসীরা বাস্তুভূমি আঁকড়ে ধরে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। বিগত ৫৩ বছরে যতবার নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জমাট বেঁধেছে ততবারই তারা তাতে সোচ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তারা অংশ নিয়েছে। সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানে আদিবাসী তরুণদের সক্রিয়তা সে কথারই সত্যতাকে তুলে ধরে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক দুদিন আগে (৩ আগস্ট) শহীদ মিনার থেকে শুরু হওয়া মিছিলে কিছু আদিবাসী শিক্ষার্থীর ব্যানারের কথা মনে পড়ছে। ব্যানারে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, সেনাশাসন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্তি পাক’। গণ-অভ্যুত্থানের প্রাথমিক যে সফলতা—স্বৈরাচারকে বিদায় করা, সেটা সম্পাদন হয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচার বিদায় নিলেও পাহাড় মুক্ত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং আমরা সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হতে দেখছি। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে, তারা নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।
দেশের সব সংকটে আদিবাসী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকলেও রাষ্ট্র তাদের কার্যকরভাবে নিজেদের নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময়ও তা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপরই সংবিধান প্রণয়নের সময় পাহাড় থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আদিবাসীসহ মেথর, পতিতা, বেদে, ভবঘুরে, শ্রমিক, মজুরের কথা সেদিনকার নীতিনির্ধারক সভায় তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল জাত্যভিমানের মুখে সংবিধানের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের ধারা (২)-এ আদিবাসীদের ‘বাঙালি’ করে রাখা হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও সেখানে আমরা আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব দেখলাম না। সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত বাংলাদেশের বহুত্ববাদকে স্বীকার করে নিয়ে সংবিধানে আদিবাসীদের সম্মানজনক স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া।
বাংলাদেশের সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানা—ব্যক্তিমালিকানা, সমবায় মালিকানা ও রাষ্ট্রমালিকানা স্বীকৃত হলেও আদিবাসীদের হাজার বছরের চর্চিত সামষ্টিক মালিকানাকে এই রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে প্রথাগত ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আদিবাসীদের যে ঐতিহ্যগত অধিকার, সেটা ক্রমাগত খর্ব করছে রাষ্ট্রীয় ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল। কাজেই আদিবাসীদের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সেসবের ব্যবস্থাপনার ওপর যে অধিকার, সেটা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ (১৩)-এর মালিকানার ধারায় ‘সামষ্টিক মালিকানা’ও সন্নিবেশিত করা জরুরি। অন্যদিকে আমাদের সামনে খুবই মৌলিক ও জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশকে একটি বহু ধর্মের, বহু সংস্কৃতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই কি না। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে সংবিধানের ২(ক) ধারার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংশোধন করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে পুনঃপ্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া। এর অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্রের নাগরিকেরা ধর্ম পালন করবেন না। মূলত এই সংশোধনীর মূল চেতনা হলো—ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যেন কোনো নাগরিক কোনোভাবে বৈষম্যের শিকার না হয়, তার নিশ্চয়তা প্রদান।
অন্যদিকে সংবিধানের ২৩(ক) ধারাকে সংশোধন করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, উপজাতি, সম্প্রদায়—সব শব্দের পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রতিস্থাপন করে প্রকৃত অর্থে আদিবাসীদের মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তাদের যে বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, সেটিকে রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
মনে রাখতে হবে, পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যে পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল, তার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র এবং আদিবাসী জনগণের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে এবং ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়নের যে ইতিহাস, সেটিকে স্বীকার করে নিয়ে পাহাড়ের আদিবাসীদের সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেই চুক্তির সফল বাস্তবায়ন আমরা আগামী সরকারগুলোর কাছে দেখতে চাই। অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে এই চুক্তির সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করাও আগামীর নীতিনির্ধারকদের একটি মৌলিক উদ্যোগ হওয়া দরকার।
পার্বত্য চুক্তির বদৌলতে পাহাড়ের আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করার জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাহাড়ের মানুষের নানা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার একটি কাঠামো তৈরি হলেও সমতলে বসবাস করা আদিবাসীদের জন্য সে রকম কোনো কার্যকর কাঠামো রাষ্ট্র এখনো গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু সব মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় সমতলের আদিবাসী-সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখার জন্য একটা পৃথক মন্ত্রণালয় কিংবা একটি পৃথক কমিশন গঠনও জরুরি। এই মন্ত্রণালয় বা কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকারসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। শুধু কাঠামো গঠন করে ঝিমিয়ে পড়লে হবে না, রাজনৈতিক সদিচ্ছার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের ভূমিসহ মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে সোচ্চার ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী।
প্রাথমিক এসব উদ্যোগই হতে পারে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং মৌলিক পদক্ষেপ, যা এত দিন কোনো সরকারই নেয়নি।
* সতেজ চাকমা : আদিবাসী অধিকারকর্মী